Tuesday, October 20, 2015

সংগ্রামী চেচেন নেতা জওহর দুদায়েভ

সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার এক মুসলিম জনপদের নাম চেচেন। সত্যি কথা বলতে কি ১৯৯১ সালের ১লা নভেম্বরের আগে বাংলাদেশের মানুষ জানতো না এই মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ চেচনিয়ার কথা। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ জনগণও এই জনপদটির খবর রাখত না। ১৯৯১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর যখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া ১৫টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে তখন চেচনিয়া স্বাধীনতার ডাক দেয়। রাশিয়ার পনেরটি প্রজাতন্ত্রের বাইরে নব্বইটি স্বায়ত্ত্বশাসিত অঙ্গ প্রজাতন্ত্র এবং অঞ্চলগুলোর মধ্যে চেচনিয়া একটি।

৬০০০ বর্গমাইল আয়তনের এ ক্ষুদ্র জনপদের লোকসংখ্যা ১৯৯০ সালের ১লা জানুয়ারী পর্যন্ত ছিল ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৭০০ জন। চেচনিয়ার রাজধানীর নাম গ্রোজনী যার লোকসংখ্যা ছিল ৪ লাখের ওপরে। গ্রোজনী শব্দের অর্থ দুর্দম্য, দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ, জাদরেল ইত্যাদি।

বর্তমানে যুদ্ধের কারণে সমগ্র চেচনিয়াতে মাত্র ৪ লাখের মত লোক অবস্থান করছে, বাকীরা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে প্রায় ২ লাখের মত চেচেন মারা গিয়েছে বলে জানা যায়। এর আগে ১৯৪৪ সালে স্টালিন সরকার গণহত্যার মাধ্যমে ‘মুসলিম সমস্যা’ সমাধানের লক্ষ্যে জোরপূর্বক ১২ লক্ষ (ঐ সময় চেচনিয়ায় ১২ লক্ষ মুসলমান ছিল) চেচেন মুসলিমকে কাজাখাস্তানে নির্বাসনে পাঠায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই ১২ লক্ষ চেচেন মুসলিমদের মধ্যে ৩ লক্ষ পথেই মারা যায়।

ইতিহাস হতে জানা যায়, চেচনিয়ার পার্শ্ববর্তী দাগাস্থানের দ্বারবন্ধ শহরে ৬৪৩ সালে ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হয়। এর আগে ৬৩৯ সালে আরবরা আজরাবাইজান দখল করে নেয়। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে পুরো দ্বারবন্ধ এলাকায় ইসলাম প্রসার লাভ করে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী চেচনিয়াতে ইসলাম প্রবেশ করতে সময় লাগে। পন্ডিতদের মতে, ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকে চেচনিয়ায় ইসলাম প্রবেশ করে। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে এসে চেচেন মুসলমানদের ওপর রুশ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। ১৫৯৪ সালে মুসলিম বনাম রুশ বাহিনী উত্তর দাগাস্থানের পুলাক নদীর তীরে রুশ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। হঠে যায় রুশ বাহিনী। ১৬০৪ সালে রুশ বাহিনী মুসলিম বাহিনীর ওপর আঘাত হেনে আবার শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। সত্যিকার অর্থে মুসলমানরা রুশ খৃস্টানদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধেই বিরাট বিজয় ছিনিয়ে আনে। প্রকৃত পক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুশ বাহিনীর সেই যুদ্ধের শুরু।

জাতীয়তার দিক হতে চেচেনরা আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অধিকাংশ জনসংখ্যা তুর্কী বংশোদ্ভুত মুসলমান। জার শাসন ও পরবর্তীকালে সত্তর বছরে কমউনিস্ট শাসনামলে চেচেন মুসলমানদের চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে তা সম্ভব হয় নি। ইতিহাস সাক্ষী চেচনিয়া কোন কালেই রাশিয়ার অংশ ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে চেচনিয়াকে জোরপূর্বক রুশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। বহুকাল ধরে রুশরা বারবার চেচেনদের ওপর হামলা চালিয়েছে কিন্তু চেচেন মুসলমানরা কোনকালেই এই অন্যায় আধিপত্য মেনে নেয় নি। বরং তাদের বিরুদ্ধে ইমাম শেখ মসুর উশুরমা(১৭৩২), শেখ মোহাম্মদ, গাজী মোহাম্মদ, গামজাতবেক, শে হাজী ইসমাঈল, মোল্লা মোহাম্মদ, জামাল উদ্দীন ও ইমাম শামিলরা আপোসহীন জিহাদ পরিচালনা করেছেন। ১৮৫৯ সালের ২৫ শে অগাস্ট ইমাম শামীল রুশ বাহিনীর কাছে সম্মানজনক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। গুনিব গ্রামের এ যুদ্ধে ইমাম শামিলের সর্বশেষ ৪০০ মুরীদের প্রায় সবাই শহীদ হন। তারপরও ১৮৫৯-৬৪ সালে পর্যন্ত চেচেনরা ককেশাসের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে চেচেনরা জার্মানকে সমর্থন দেয়ায় স্ট্যালিন লক্ষ লক্ষ চেচেনকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে কাজাখস্থানে নির্বাসন দন্ড প্রদান করে। এই নির্বাসন চলাকালে ১৯৪৪ সালের ১৫ এপ্রিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ পিয়ার ভোমায়াস্কা এলাকার ইয়ালখের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা ছিলেন মূসা এবং মাতার নাম ছিল আলেপতিনা কেদোরভনা দুদায়েভ। দুদায়েভের আব্বা ছিলেন জাতিতে চেচেন এবং মা ছিলেন রুশ। মোট ৭ ভাই বোনের মাঝে দুদায়েভ ছিলেন সবার ছোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়ায় তাঁর আব্বা ও বড় ভাইকে শহীদ করে দেয় স্টালিনবাহিনী।
দুদায়েভ রাডিকাফ কাজে ইলেক্ট্রনিক্স্রের ওপর দু’বছর পড়াশোনার পর সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালের রাশিয়ার তাম্বর শহরের বৈমানিক প্রশিক্ষণ কেনেদ্র তাঁর সামরিক শিক্ষা শুরু হয়। জাতিগতভাবেই রুশরা অন্তর থেকেই চেচেনদের ঘৃণা করে। এরপরও জওহর দুদায়েভ আপন প্রতিভা বলে সমস্ত প্রকার বাধা অতিক্রম করে রাশিয়ার সেরা সামরিক স্কুল ইউরি গ্যাগারিন এয়ারফোর্স একাডেমী, মস্কোতে শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার গতানুগতিক নিয়মে দুদায়েভ ১৯৬৮ সাল হতে ১৯৯১ সাল পর্য্ন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৬-৭৯ পর্যন্ত দুদায়েভ রাশিয়ার এয়ারফোর্স রেজিমেন্ট এর চীফ অব স্টাফ, ১৯৭৯-৯০ কমান্ডার অব ডিভিশন এবং ১৯৯০ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এরপর দুদায়েভ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য চেচেন জাতির মহাসম্মেলনের নির্বাহী কমিটির প্রধান ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও অলঙ্কৃত করেন।
জওহর দুদায়েভ আল্লা নাম্নী এক রুশ মহিলাকে বিয়ে করেন এবং তাদের ২ ছেলে ও ১ মেয়ে ছিল।
দুদায়েভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর মাঝে জাতীয় চেতনা ও অতীত ঐতিহ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। ফলে চেচেত জাতির ভেতর তাঁদের পূর্ণ মুসলিমসত্ত্বা জাগ্রত হয়ে ওঠে। তারা সে বছরেই দুদায়েভের নেতৃত্বে চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যে স্বাধীনতা ছিল চেচেন জাতির আবহমানকালের লালিত স্বপ্ন। ১৯৯৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন যখন তার তিন ডিভিশন সৈন্যকে চেচনিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন তখন দুদায়েভ চেচেন জাতির আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে ওঠেন। চিরসংগ্রামী চেচেন জনগণ তাঁর নেতৃত্বে সুশিক্ষিত বিশাল রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যে মরনপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তা যে কোন স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
১৯৯৫ সালে দুদায়েভের বড় ছেলে রুশদের অস্ত্রে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে শহীদ হন এবং ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকে তাঁর জামাতা সালমান রাদুয়েভও শহীদ হন।
দুদায়েভের প্রিয় শখ ছিল কারাতে ও সঙ্গীত। তিনি পুশকিন ও লের মগুভের কবিতা পড়তে ভালবাসতেন। কারণ ছিল এ দু’জন কবি ককেশাসকে অত্যন্ত ভালবেসেছিলেন এবং ককেশাসের উপর তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা আছে।
দুদায়েভ কুরআন তিলাওয়াত করতে ও শুনতে ভালবাসতেন। তিনি খুব ফুল প্রিয় লোক ছিলেন। যে কারণে ফুলের বাগান পর্যন্ত করেছেন। দৈহিকভাবে ছোটখাট এ মানুষটি ছিলেন প্রাণোচ্ছ্বল জীবন্ত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। এখনকার কিংবদন্তী।
চেচনিয়াকে নিয়ে ছিল তার সীমাহীন স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন চেচনিয়ায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি চেচনিয়ার মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। চেচনিয়াকে তিনি ১৯৯১-১৯৯৪ পর্যন্ত তিন বছরের কিছু বেশি সময় স্বাধীন রাখতে পেরেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি এক দুদায়েভই ছিলেন চেচেন জাতির স্বাধীনতার প্রতীক। দুর্ধর্ষ ককেশীয় চেচেন জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকারী।
আজাদী পাগল চেচেনরা পাহাড়ী অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ঠিক করে বিশাল রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ২১শে এপৃল ১৯৯৬ তারিখে চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় মহানায়ক, চেচেনদের নয়নের মনি, চিরসংগ্রামী নেতা জওহর দুদায়েভ স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গ্রোজনী হতে ৩০ কিমি দূরে জেখেসু গ্রামের একটি মাঠে শাহাদাতবরণ করেন। এ সময় তিনি চেচেন সংকট নিরসনের জন্য মধ্যস্থতার ব্যাপারে স্যাটেলাইট টেলিফোনে আলাপ করছিলেন। জানা যায়, কাপুরুষ ইয়েলৎসিন বাহিনী কৌশলে স্যাটেলাইট টেলিফোনের অবস্থান জেনে নিয়ে রুশ বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইতিহাস বলে চেচেন মুসলমানরা আজাদী পাগল এক যোদ্ধা জাতি। সত্যিই তারা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে। আর যারা মৃত্যুকে ভয় পায় না, বিজয় তাদের অনিবার্য। হতে পারে সেটা সময় সাপেক্ষ। প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ শহীদ হলেও চেচনিয়ার ঘরে ঘরে হাজার হাজার দুদায়েভ এখন তৈরী হবে, জন্ম নেবে।
Read More »

রাজপুত্তুর কবি

এই হিং নেবে হিং, কিসমিস, খুবানি, আঙুর, পেস্তা, বাদাম, আখরোটঃ নে-বে। লম্বা পিরহানের জেবে কলসী ভাঙা চাড়া, কড়ি এসব ভরে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তুলে দরাজ গলায় হেঁকে চলেছে এক কিশোর। বড় বড় উজ্জ্বল দুটি চোখ। যেন সে দুটি চোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ছে সত্যের দ্যুতি। লম্বা বাঁকানো বাঁশির মত নাক, প্রশস্ক কপাল, ঘাড় অবধি নেমে যাওয়া ঝাঁকড়া চুল-সব মিলিয়ে এক অপরূপ রাজপুত্তুর। কাবুলিওয়ালা সাজার ইচ্ছায় যে রাজপুত্তুর বেশ হাঁক-ডাক করতো।
রাজপুত্তুরটির যেমন ছিল দরাজ গলা, আগুনঝরা চোখ, বাবরীদোলানো চুল, তেমনি ছিল দুরন্ত সাহস। ভয় কখনো তাঁর দিলে বাসা বাঁধেনি। যা সত্য, যা সুন্দর তা সে আজীবনই মেনে চলেছে, সমাজেও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
তোমরা হয়ত ভাবছ, সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের কোন কথা বলছি। না, আসলে তা নয়। এর রাজপুত্তুরটি রাজমহল আমাদের দেশের এক গন্ডগ্রামে। অতীতকালে তাঁর এলাকাটা শাসন করেছে রাজা প্রতাপাদিত্য, রাজা বিক্রমাদিত্য, খান জাহান আলীর মত রাজা বাদশাহরা। হ্যাঁ, দেশটির নাম যশোরাদ্য দেশ। পরে এটা যশোর জেলা নামে পরিচিত হয়। এ জেলারই মাগুরা মহকুমার আওতাধীন মাঝাইল গ্রামে সে রাজমহল। রাজপুত্তুরটির নাম ফররুখ। পুরো নাম সৈয়দ ফররুখ আহমদ।
১৯১৮ সালের ১০ই জুন ফররুখ আহমদ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন এক জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। মায়ের নাম বেগম রওশন আখতার। মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান তিনি।
গ্রামের স্কুলেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর কলকাতার তালতলি মডেল স্কুলে, বালিগঞ্জ হাইস্কুলে, খুলনা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করেন। খুলনা জেলা স্কুল হতে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে পড়াকালে কবি গোলাম মোস্তফাকে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। আর খুলনা জেলা স্কুলে পান কবি আবুল হাশিম ও অধ্যাপক আবুল ফজলকে শিক্ষক হিসেবে। কলকাতার রিপন কলেজ হতে ১৯৩৯ সালে তিনি আইএ পাশ করেন। পরে দর্শনে অনার্স নিয়ে বিএ ভর্তি হন। আরো পরে ইংরেজিতে অনার্স নেন। ‍কিন্তু ঐ পর্য্ন্ত যে কোন কারণেই হোক তাঁর আর অনার্স পরীক্ষা দেওয়া হয় নি।
হ্যাঁ, রাজপুত্তুরটি ছিলেন সত্যি সত্যিই রাজপুত্তুরের মত। যখন হাঁটতেন মনে হত কেশর দুলিয়ে সিংহের বাচ্চা হেঁটে যাচ্ছে। হাঙর কুমিরকে থোড়াই কেয়ার করে দলবল নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনি বলতেন, ‘হাঙর কুমির যদি থাকে, আমার ভয়েই তারা পালিয়ে যাবে।’ সারা জীবন এমনই তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, কারো কাছে কোনদিন কোন কারণে মাথা নত করেন নি।
রাজপুত্তুরটি ছিলেন খুবই ভাবুক প্রকৃতির। রাতের বেলা যখন আকাশে চাঁদ হেসে উঠতো তখন বিছানা ছেড়ে চলে যেতেন ডাহুক ডাকা বাঁশঝাড়টার কাছে। চুপচাপ শুনতেন ডাহুকের ডাক আর কবিতা লিখেতেন-
রাত্রিভর ডাহুকের ডাক……
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধ দীঘি অতল সুপ্তির
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি
কানপেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
আবার-
          তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
          ক্রমাগত ভেসে আসে পালক মেঘের অন্তরালে
          অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
          স্বপ্নের প্রবাল।
মাঝে মাঝে তিনি বাড়ির পুচকে পুচকে পাইক বরকন্দাজ নিয়ে বেড়াতে বের হতেন্, যেন রাজপুত্তুরের হরিণ শিকার। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন মধুমতির তীরে। পলকহীনভাবে দেখতেন নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার জাহাজের আনাগোনা। শুনতেন মাঝি-মাল্লার দাঁড় ফেলার শব্দ, হাঁক-ডাক। এসব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যেতেন। সাথীদেরকে এসময় দিতেন ভূগোলের জ্ঞান। বলতেন, “পাহাড় হতে এসেছে এই নদী। তারপর চলে গেছে দক্ষিণে, সেখানে আছে বঙ্গোপসাগর, তারপর আরব সাগর। নৌকা চড়ে ভেসে যেতে কোনো বাধা নেই, কোনো মানা নেই। কিন্তু সাবধান, হুঁশিয়ার। আসবে ঝড়, উঠবে তুফান, বড় বড় কুমীর আর হাঙর মাতামাতি করবে। আল্লাহ আল্লাহ করে নৌকা ছাড়লে আর কোন ভয় নেই।”
কবি ফররুখ আহমদ চেয়েছিলেন এই ঘূনে ধরা সমাজটাকে ভেঙ্গে একটা সুন্দর সমাজ গড়তে।
তাঁর কথায়-
          আল্লাহর দেওয়া বিশ্ববিধান
          ইসলামী শরীয়ত
          যে বিধানে মোরা গড়িয়া তুলিব
          এই পাক হুকুমত।।
          তৌহিদে রাখিয়া দৃঢ় বিশ্বাস
          আমরা সৃজিব নয়া ইতিহাস
          দেবো আশ্বাস দুনিয়ার বুকে
          দেখাব নতুন পথ।।
          সারা ‍মুসলিম দুনিয়াকে বেঁধে
          একতার জিনজিরে
          ফিরায়ে আনাব হারানো সুদিন
          নয়া জামানার তীরে।।
          আলী, উসমান, উমরের দান
          নেব তুলে মোরা জেহাদী নিশান
          নেব ফেরা মোর আবূ বকরের
          সত্য সে খেলাফত।
কবির দৃঢ় বিশ্বাস আগের দিনে যারা জাতির নেতৃত্ব দিয়েছে, তাঁদের ত্রুটির কারণেই আজ মুসলিম জাতি এই খারাপ অবস্থায় পৌছেছে। যেমন-
              শুধু গাফলাতে, শুধু খেয়ালের ভুলে
              দরিয়া অথই ভ্রান্তি নিয়াছে তুলে
              আমাদেরই ভুলে পানির কিনারে,
              মুসাফির দল বসি,
              দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের,
              সেতারা শশী।
              মোদের খেলাধূলায় লুটায়ে পড়ি
              কেঁদেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্ববরী। (পাঞ্জেরী)।
সারা দুনিয়ায় আবার নতুন করে মুসলিম জাগরণ শুরু হয়েছে। আবার যেন নতুন সূর্য্ ওঠার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি লিখেছেন-
              কেটেছে রঙ্গিন মখমল দিন, নতুন
              সফর আজ,
              শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,……….
              …………………………………………
              নতুন পানিতে সফর এবার এ
              মাঝি সিন্দাবাদ। (সিন্দাবাদ)।
কিন্তু আমাদের জাতির নেতারা যখন হতাশ, সাহসহারা তখনো রাজপুত্তুর তার সাহসে ভর দিয়ে বলেছেন-
              আজকে তোমায় পাল ওঠাতেই হবে,
              ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
              ভাঙ্গা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
              তবুও জাহাজ আজ ওঠাতেই হবে। (সাত সাগরের মাঝি)।
কবির রাজপুত্তুরটি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এই দৃঢ় প্রত্যয়ী রাজপুত্তুরটি তার জীবনেও ইসলামী অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। কোন ঝড়, কোন বিপদ তাঁকে এপথ হতে চুল পরিমাণও সরাতে পারে নি।
তিনি বিপদ মুসিবতের সময় ভেঙ্গে পড়াকে ঘৃণা করতেন। এই সময় আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য চাওয়াটাও মোটেই পছন্দ করতেন না। কবি লিখেছেন-
          তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদার মদদ ছাড়া
পরের ওপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া।
এমনিভাবে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে দেশ জাতির মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি তোমাদের জন্য অনেক ভাল ভাল বই লিখেছেন। যেমন-‘পাখির বাসা’, ‘হরফের ছড়া’, ‘নতুন লেখা’, ‘ছড়ার আসর’, ‘নয়া জামাত’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি। ‘পাখির বাসা’ বইটির জন্য তিনি ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও কবি পেয়েছেন-বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার।
Read More »

বন্দে আলী মিয়া

তোমাদেরকে এখন এমন এক ব্যক্তিত্বের কথা বলব যিনি তাঁর সিংহভাগ সময় এবং শ্রম তোমাদের জন্যই ব্যয় করেছেন। তিনি হলেন কবি বন্দে আলী মিয়া। জানি এ নামটি তোমাদের পরিচিত ও প্রিয়। বন্দে আলী মিয়া ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারী পাবনা শহরের শহরতলীর রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম মুনসী উমেদ আলী মিয়া এবং মাতার নাম নেকজান নেছা। সাহিত্যে প্রায় সকল বিষয়ে-ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, জীবনী, রহস্য-রোমান্স, রূপকথা, উপকথা ইত্যাদি নিয়ে তিনি লিখেছেন। এসব বিষয়ে তিনি বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, ছোটদের জন্য লিখেছেন তার ঢের বেশি। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন স্বার্থক শিশু সাহিত্যিক।
কবি বন্দে আলী মিয়ার শিক্ষা জীবন শুরু হওয়ার পূর্বেই তাঁর স্নেহময়ী পিতা ইন্তিকাল করেন। মা নেকজান নেছা ইয়াতীম শিশুপুত্রকে গ্রামের মজুমদার একাডেমীতে ভর্তি করে দেন এবং এখান হতেই ১৯২৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছবি আঁকতে কবি খুব ভালবাসতেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাসের পর তিনি কলকাতার বৌ বাজারে অবস্থিত ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন এবং ১৯২৭ সালে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর উৎসাহে তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সাদত কলেজে আই.এ ভর্তি হন। কিন্তু কলকাতা ছেড়ে মফস্বলের কলেজ ভাল না লাগায় ১৯২৯ সালে কলেজ ত্যাগ করেন ও তাঁর আর পড়াশোনা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এরপরই বন্দে আলী মিয়া মায়ের একান্ত আগ্রহে বগুড়া শহরের বৃন্দাবন পাড়া নিবাসী রাবেয়া নামের এক সুন্দরী রমনীকে বিয়ে করে সংসারী হয়ে ওঠেন।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৩০ সালে কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন এবং একটানা কুড়ি বছর এ চাকরিতে বহাল ছিলেন। এই শিক্ষকতার জীবনেই তিনি শিশুদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ভালভাবে শিশুমনকে জানার সুযোগ পান। তিনি নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে শিশুদের মতই সহজ সরল ছিলেন। তাঁর মুখে সব সময় হাসির একটা মিষ্টি ঝিলিক ছড়িয়ে পড়তো। দেখামাত্রই ছোটদেরকে কাছে টানার তাঁর চমৎকার সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। শিশুদের কাছে তিনি কবি দাদু হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি ঐ সময়ে ‘ছেলে ঘুমানো’ নামক শিশু অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিদিন শিশু উপযোগী গল্প গান ইত্যাদি লিখে দিতেন।
কবি নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকায় তাঁর ‘ছিন্নমূল’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে কবির শিশু কিশোরদের উপযোগী প্রথম বই ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের ছবিগুলি কবির নিজের হাতে আঁকা। ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হওয়ার পর কবি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ছবি এঁকেও কবি ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আঁকা মোনাজাতের ছবিটি ব্যাপক প্রচার ও প্রশংসা লাভ করে।
কবি বন্দে আলী মিয়ার তোমাদের জন্য লেখা অনেক মনগড়া কবিতা রয়েছে।
যেমন-
আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘী,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি। (আমাদের গ্রাম)।
কি চমৎকার কবিতা, তাই না? কবিতাটি ভিতর কোন যুক্তাক্ষর নেই। কারণ কবি শিশু মন বুঝতেন, তাঁদের কষ্টের কথা বুঝতেন। তাই তিনি যতদূর সম্ভব সহজ সরল অথচ সুন্দর ভাষায় লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন-
আয় আয় পিস পিস,
দেখ ভাই ময়না,
চুপ চুপ, গোলমাল
কথা আর কয় না। (আফরোজার পুষি)।
ব্যাঙের বিয়ে ছড়াতে লিখেছেন-
ছোট কোলা ব্যাং
ডাকে গ্যাং গ্যাং।
তার নাকি বিয়ে
টুপি মাথায় দিয়ে।
কবি বন্দে আলী মিয়ার প্রায় পৌণে দুইশত বই এর মাঝে ১২৫ খানা বই-ই ছোটদের উপযোগী। এর মধ্যে ইতিহাস আশ্রয়ী বই, যেমন-ছোটদের বিষাদ সিন্ধু, তাজমহল, কোহিনূর, কারবালার কাহিনী ইত্যাদি। তিনি কোরআন ও হাদীসের কাহিনী নিয়েও গল্প লিখেছেন, আবার গুলিস্তাঁর গল্প, ঈশপের গল্প, দেশ-বিদেশের গল্প, শাহনামার গল্প। তিনি অনেকগুলি জীবনী লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- আমাদের নবী, হযরত আবূ বকর, হযরত ওমর ফারুক, হযরত খাদিজা, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা, হযরত ফাতিমা, হযরত মূসা, তাপসী রাবেয়া, সিরাজউদ্দৌলা, হাজী মহসিন, ছোটদের নজরুল ইত্যাদি।
এসব লেখার মধ্য দিয়ে তিনি আগামী দিনের নাগরিক শিশু কিশোরদের চরিত্র গড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি ভাল করেই জানতেন-
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা
 সব শিশুরই অন্তরে।’
ইসলামের সুমহান আদর্শ শিশুদের কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরার জন্য পবিত্র কুরআনের ১৫টি কাহিনী নিয়ে তিনি ১৫টি গল্প লিখেছেন। হৃদয়-গ্রাহী ভাষায় লেখা এ গল্পগুলি হল-আদি মানব ও আজাযিল, স্বর্গচ্যুতি, হাবিল ও কাবিল, মহাপ্লাবন, আদ জাতির ধ্বংস, ছামুদ জাতির ধ্বংস, বলদর্পী নমরুদ, হাজেরার নির্বাসন, কোরবানী, কাবা গৃহের প্রতিষ্ঠা, ইউসুফ ও জুলেখা, সাদ্দাদের বেহেশত, পাপাচারী জমজম, কৃপণ কারুন, ফেরাউন ও মূসা ইত্যাদি।
পবিত্র হাদীস হতে ১৪টি কাহিনী নিয়ে তিনি লিখেছেন ১৪টি গল্প। বইয়ের নাম দিয়েছেন-‘হাদীসের গল্প’। এ বইয়ের গল্পগুলি এ রকম-দীন জনে দয়া করো, সত্য নিষ্ঠার পুরস্কার, ক্ষুধাতুরে খাদ্য দাও, স্বল্প কথা, খোড়া শয়তানের বাহাদুরী ইত্যাদি।
তাঁর গল্প লেখার নমুনা এরকম-‘এক দেশের এক রাজা। রাজার হাতীশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া, রাজকোষে হীরামানিক, তবু রাজার মনে সুখ নেই। রাজার কোন ছেলে পুলে নেই। একটি মেয়েও যদি হতো তবু রাজা-রাণীর মনে সুখ থাকতো।’
অন্যত্র লিখেছেন-
বাঘঃ হালুম-খক খক খেঁকশিয়াল সাহেব। আদাব।
খেঁকশিয়ালঃ মাননীয় বাঘ বাহাদুর যে, আসুন, আসুন, আদাব। আপনি বনের বাদশা, শত কাজ ফেলে সময় করে যে আমার পুত্রের বিবাহে আসতে পেরেছেন-আমার নসিব। আপনার পলাশ ডাংগায় সবাইকে যে দাওয়াত করেছিলুম, তারা এখনো এসে পৌছুলেন না।
বাঘঃ আমি না আসলে তো কউ আগে আসতে পারেন না। ঐ যে আসছেন সবাই। কি হে পন্ডিত এত দেরী যে?
শৃগালঃ ক্যাহুয়া, ক্যাহুয়া। একটু দেরী হুয়া। আসবার পথে একটা রামছাগলের বাচ্চা পেলুম। নাশতাটা না সেরে আসি কি করে? জানিতো বিয়ে বাড়িতে কখন বরাতে জুটবে বলা যায় না। (বিড়ালের প্রবেশ)।
বাঘঃ পন্ডিত রসিক লোক, নাশতা হয়েছে ভালই হয়েছে। এই যে সরকার সাহেব, আদাব।
বিড়ালঃ আদাব, খেঁকশিয়াল সাহেব। আপনার পুত্রকে এই ইদুরের মুক্তা মালা ছড়া আমার আশীর্বাদ দেবেন।
খেঁকশিয়ালঃ এসব আবার কেন? নিমন্ত্রণ পত্রে তো উল্লেখ ছিল, ‘লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ প্রার্থনীয়’। তা মালাছড়া যখন এনেছেন-(কুমীরের প্রবেশ)
‘খেঁক শিয়ালের দাওয়াত’ (টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার)।
কার না ভাল লাগে পশুদের এমন চমৎকার সংলাপ? কবি বন্দে আলী মিয়া শিশু কিশোর উপযোগী জীবনী গ্রন্থগুলো রচনা করেছেন অসম্ভব হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয় করে। তিনি ‘আমাদের নবী’ গ্রন্থে মহানবী(সা) সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। সেই চাঁদের আলোকে চারিদিক পুলকিত। বিবি আমিনা এক ঘরে ছটফট করেছেন। প্রহরের পর প্রহর কাটতে থাকে। নিখিল বিশ্ব স্তব্ধ নীরব। রাতের শেষ প্রহর, চাঁদ আকাশের গায়ে হেলে পড়েছে। বিবি আমিনার আঁধার ঘর আলোকিত করে একটি ফুটফুটে সুন্দর শিশু ভূমিষ্ট হলেন।
………..বাতাস ছুটে এসে খর্জুর বীথি আর আঙ্গুর গুচ্ছকে খোশ আমদেদ জানিয়ে গেল। জাফরানের খুশবু এই খবর নিয়ে ছুটলো মরু আরবের দিগ দিগন্তে।
এসেছে দীনের নবী
 মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লে আলা
তাঁহারি রওশানিতে
 জাহান হলো উজ্জ্বালা।।
এ প্রাণস্পর্শী বর্ণনা নিঃসন্দেহে বড়দেরও হৃদয় না কেড়ে পারে না।
কবি বন্দে আলী মিয়ার লেখার প্রশংসা করেছেন বাংলা সাহিত্যের বড় বড় দিকপালেরা। এর মধ্যে রয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাকবি কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসীম উদ্দীন, কবি সমালোচক আবদুল কাদির প্রমুখ। আর ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ওপর জ্ঞানগর্ভ একটি পুরো প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা ব্যাপড় সাড়া ফেলেছিল। কবির কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে শিশু সাহিত্যে পুরস্কার প্রদান করে। আর ১৯৬৫ সালে তাঁকে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য দেয়া হয় প্রেসিডেন্ট পুরস্কার।
এই নিরলস শিশু সাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়া ২৮ জুন, ১৯৭৯ সালে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। আমাদের জানামতে তাঁর ২৫ টা অপ্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে যা বাংলা একাডেমী ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মত প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করি। তাঁর রচনাবলীও প্রকাশ হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
Read More »

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন

আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।
হ্যাঁ। এ জসীম উদ্দীনে কবিতার লাইন। জসীম উদ্দীনের কবিতার ধরনই আলাদা, স্বাদই আলাদা। তিনি গ্রাম বাংলার সাধারণ আষয় বিষয়, সাধারণ মানুষের জীবন অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। সত্যিকার অর্থে এমনটি আর কোন কবি সাহিত্যিক করেন নি। যার কারণে বাংলার মানুষ তাদের এই প্রিয় কবিকে পল্লীকবি বিশেষণে বিশেষিত করেছে।
১৯০৩ সালে ১ জানুয়ারী ফরিদপুর সংলগ্ন তাম্বুলখানা গ্রামে মামার বাড়িতে জসীম উদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাসও ফরিদপুর জেলা শহরের উপকন্ঠ গোবিন্দপুর গ্রামে। কবির পিতার নাম মৌলভী আনসার উদ্দীন। তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। আনসারউদ্দীন সাহেব এর হাত দু’টি ছিল আজানুলম্বিত এবং মুখ ভরা ছিল চাপ দাড়ি। এতে করে কবির পিতাকে অসম্ভব সুপুরুষ ও সুদর্শন মনে হত। তা’ছাড়া সাদা ধুতি পরে, গায়ে পাঞ্জাবী চাপিয়ে যখন মাথায় টুপি দিতেন তখন তাঁকে আরো আকর্ষণীয় চেহারার মানুষ মনে হত। সাদা পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন কবির পিতা গ্রামের এম.ই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
জসীম উদ্দীনের লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয় তাঁর পিতা আনসার উদ্দীনের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় পার্শ্ববর্তী শোভারামপুরের আম্বিকা পন্ডিতের পাঠশালায়। এখান থেকে তিনি গ্রামের এম.ই স্কুলে চলে আসেন এবং পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করেন। ঐ পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালে তাঁকে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করা হয়। আজন্ম রসিক জসীম উদ্দীন এ স্কুলে ভর্তি হবার পর স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্ররা তাঁকে কিভাবে গ্রহণ করেছিল তা অত্যন্ত রসিয়ে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সন্নাসীর ভক্ত হইয়া আমি পায়ে জুতা পরিতাম না। পাড়হীন সাদা কাপড় পড়িতাম। ক্লাসের ছাত্ররা প্রায় সবাই শহরবাসী। আামকে তাহারা গ্রাম্য ভূতের মতই মনে করিত। আমি কাহারো কাছে যাইয়া বসিলে সে অন্যত্র বসে। আমি শত চেষ্টা করিয়াও কাহারো সাথে ভাব জমাতে পারি নাই। আমি সঙ্কোচে পেছনের বেঞ্চে আমার চাচাতো ভাই নেহাজ উদ্দীনের সঙ্গে জড়সড় হইয়া বসিয়া থাকিতাম। শিক্ষকেরা অন্য ছাত্রদের লইয়া কতো হাসি তামাসা করিতেন, এটা ওটা প্রশ্ন করিতেন। আমাদিগকে কিছুই জিজ্ঞাসা করিতেন না।”
বুঝতেই পারছো, কবির এ বর্ণনার মধ্যে তাঁর ছোটকালের ব্যথাতুর মনের পরিচয় পাওয়া যায়। শত অবহেলার মধ্যেও এ স্কুল হতেই কবি ১৯২১ সালে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ হতে ১৯২৪ সালে আই.এ এবং ১৯২৯ সালে বি.এ পাশ করেন। বিএ পাশ করার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৩১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন।
জসীম উদ্দীনের বাল্যকাল খুবই আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে কেটেছে। তিনি নিজেই লিখেছেন, “আমাদের দু’খানা খড়ের ঘর। চারিধারে নলখাগড়ার বেড়া। চাটাইয়ের কেয়ার বা ঝাঁপ বাঁধিয়া ঘরের দরজা আটকানো হয়। সেই ঘরের অর্ধেক খানিতে বাঁশের মাচা। মাচায় ধানের বেড়ি, হাড়ি-পাতিল থরে থরে সাজানো। সামনে সুন্দর কারুকার্য্ খচিত বাঁশের পাতলা বাখারী দিয়া নক্সা করা একখানি বাঁশ টাঙান।…………এই ঘরের মেঝেতে সপ বিছাইয়া আমরা শুইয়া থাকিতাম।—–বাজান ঘর-সংসারের কাজ ফেলিয়া স্কুলে যাওয়া আসা করিতেন বলিয়া দাদা ছমির উদ্দীন মোল্লা বাজানের ওপর বড়ই চটা ছিলেন। বাজান তাঁহার একমাত্র পুত্র। বৃদ্ধ বয়সে তিনি সংসারের সকল কাজ দেখাশুনা করিতে পারিতেন না। কোনো কঠিন কাজ করিতে কষ্টসাধ্য হইলে তিনি বাজানকে খুব গালমন্দ করিতেন।” সত্যিই কবি সবদিক থেকে এদেশের মানুষের হৃদয়ের অত্যন্ত কাছাকাছির মানুষ ছিলেন।
কবির পিতা আনছারউদ্দীন সাহেব যেমন অত্যন্ত পরিপাটি ও ছিমছাম মানুষ ছিলেন, কবি ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ অগোছালো ছিলেন। বাল্যকালে কবি এক সাধুর শিষ্য হয়েছিলেন। সাধুর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণে তিনি সাধুর জীবন গ্রহণের মানসে ঐ বাল্যকালেই পায়ে জুতা পরিতেন না, গায়ে জামা পরতেন না। শুধুমাত্র পাড়হীন একখন্ড সাদা ধুতির মত কাপড় দিয়েই সব কাজ চালাতেন। কখনো যদি জামা পরেছেন তো সে জামা হতো বোতামহীন।
কবির বাবা আনসারউদ্দীন ও একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি কথায় কথায় কবিতা ছড়া বাঁধতে পারতেন বলে জানা যায়। এ প্রসংগে ইসলামী বিশ্বকোষ লিখেছে, “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ছিল তাঁর অগাধ অনুরাগ। তাঁহার কবিত্বও শক্তিও ছিল। গাজীপুর উপজেলার কবি গোবিন্দদাসের ন্যায় তিনি স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পদ্য রচনা করিতে পারিতেন। জসীমউদ্দীন উত্তরাধিকার সূত্রে সকল পৈতৃক গুণের অধিকারী হয়েছিলেন।”
দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন জসীম উদ্দীন রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতা যা ১৯২৬ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘কবর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর রাতারাতিই জসীম উদ্দীনের কবিখ্যাতি বাঙালী পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্র-নজরুল যুগে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরের এ কবিতা পড়ে ডঃ দীনেস চন্দ্র সেন কবিকে লিখেন, “দুরাগত রাখালের বংশী ধ্বনির মত তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি।” ডঃ সেন ইংরেজী পত্রিকা Forward এ জসীম উদ্দীনের ওপর একটি পুরো ইংরেজী প্রবন্ধ লিখেন, যার শিরোনম ছিল `An young mohammadan poet’.
সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, কবি যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র তখনই এই ‘কবর’ কবিতাটি পুস্তকে সংকলিত হয় এবং ম্যাট্রিক ক্লাসে পাঠ্য হয়।
ছাত্রাবস্থায়ই কবি কর্মজীবনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৪ সালে তিনি ৭০ টাকা আর্থিক মাসোহারার বিনিময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পল্লী সাহিত্য সংগ্রাহক নিযুক্ত হন। এম.এ পাস করার পূর্ব পর্যন্ত এ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এরপর ড. দীনেস চন্দ্র সেনের অধীনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতন লাহিড়ী রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট নিযুক্ত হন এবং ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৩৭ সালে কবি বিবাহ করেন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক সরকারের প্রচার বিভাগের পাবলিসিটি অফিসার পদে যোগ দেন এবং ১৯৬৮ সালে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এ সময়ে কন্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দীন তাঁর সহকর্মী ছিলেন।
কবির মনটি ছিল আকাশের মত উদার। আর সে মানুষ যদি হয় গায়ের লোক, বা তোমাদের শিশু কিশোর তা’হলে তো কথাই নেই। ছোট সুন্দর ফুটফুটে খুকী দেখলে কবি অমনি খলবলিয়ে বলে উঠেন-
“এই খুকীটি আমায় যদি একটু আদর করে
 একটি ছোট কথা শোনায় ভালবাসায় ভরে;
 তবে আমি বেগুন গাছে টুনটুনিদের ঘরে,
 যত নাচন ছড়িয়ে আছে আনব হরণ করে;
 তবে আমি রূপকথারি রূপের নদী দিয়ে,
 চলে যাব সাত সাগরে রতন মানিক নিয়ে;
 তবে আমি আদর হয়ে জড়াব তার গায়,
 নুপুর হয়ে ঝুমুর ঝুমুর বাজত দুটি পায়।”
আসমানী কবিতায় দরিদ্র, অভাব অনটনে জর্জরিত শিশুদের নিয়ে তিনি লিখেছেন-
“পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের কখান হাড়,
 সাক্ষী দিছে অনাহারে ক’দিন গেছে তার।
 মিষ্টি তাহার মুখটি হ’তে হাসির প্রদীপ রাশি
 তারপরেতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।”
 এমনি দরদ দিয়ে লিখতে পারা সত্যি সবার পক্ষে সম্ভব নয়।
ছোটদেরকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছেন-
“আমার বাড়ি যাইও পথিক
বসতে দেবো পিঁড়ে
জলপান যে করতে দেবো
শালি ধানের চিড়ে।
উড়কি ধানের মুড়কি দেব
বিন্নী ধানের খই
ঘরে আছে ফুল বাতাসা
চিনি পাতা দই।”
কি জিহবায় পানি এসে যাচ্ছে, তাই না? আবার শহুরে বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে লিখেছেন-
  “তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে
  আমাদের ছোট গায়
  গাছের ছায়ায় লতায় পাতায়
  উদাসী বনের বায়।”
ইত্যাদি হাজারো উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে তাঁর লেখা হতে।
তাঁর শিশুতোষ লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- হাসু, একপয়সার বাঁশি, ডালিম কুমার এবং বাংগালীর হাসির গল্প ১ম ও দ্বিতীয় খন্ড। তিনি শুধু ছোটদের জন্যই লিখেন নি, বড়দের নিয়েও প্রচুর লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কাব্য ২০ খানা, নাটক ১৩ খানা, জারী ও মুর্শিদী গানের সম্পাদনা করেছেন দু’খানা বই।
কবির বহুল পাঠ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ও রাখালী। যা দেশে বিদেশে কবিকে বহুল পরিচিতি ও খ্যাতির আসনে সমাসীন করেছে।
নকশী কাঁথার মাঠ, বেদের মেয়ে, বাংলাদেশের হাসির গল্প ও জসীম উদ্দীনের নির্বাচিত কবিতা ইংরেজী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবি বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি ‘হলদে পরীর দেশ’ নামক গ্রন্থের জন্য ইউনেসকো পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে বাঙালীর এই প্রিয় কবি, পল্লী কবিকে বাংলা একাডেমী কোন সম্মানে ভূষিত করেনি। এটা বাংলা একাডেমী ও এ জাতির জন্য সত্যিই লজ্জার। অবশ্য তাঁর বাসস্থান ‘পলাশ বাড়ি’ যে রোডে অবস্থিত তার নাম ‘কবি জসীম উদ্দীন স্মরণী’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নাম ‘কবি জসীম উদ্দীন হল’ রাখা হয়েছে।
কবি জসীম উদ্দীন তাঁর নিজ বাসভবন ‘পলাশ বাড়ি’তে ১৯৫৩ সাল হতে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করে আসছিলেন, যা আমৃত্যু জারি রেখেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ তারিখে সাহিত্য সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সাহিত্যিক সাংবাদিক মোদাব্বের ও কবি আজিজুর রহমান উপস্থিত হয়ে সাহিত্য সভার বদলে কবির জানাযা পড়েছিলেন। অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ তারিখে বাংলার আপামর জনসাধারণের নয়নের মণি পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ইন্তিকাল করেন। এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
Read More »

বিদ্রোহী শাহজাদা

ছোটটো একটি গ্রাম। তাও আবার আমাদের এই বাংলাদেশে নয়। একেবারে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার অজপাড়াগাঁয়ে। চারদিকে ধান কাউনের উম উম গন্ধ। পাখ-পাখালির কিচির মিচির আওয়াজ। সন্ধ্যায় শোনা যায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝাঁঝাল ডাক। কি সুন্দর তাই না? এই গ্রামের মানুষ আবার লেটো গান ভালবাসতো। একদিন রাতে তারা ‘লেটো’ গানের আসর বসালো। আশ-পাশের বিশ গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে গান শুনতে!
গানতো নয়, লড়াই! পুরোপুরি দুই দলের লড়াই। তবে গোলা বন্ধুক দিয়ে নয়, কবিতা দিয়ে। কি মজার কান্ড বলতো। তুমুল লড়াইয়ের পর এক পক্ষ হারে হারে অবস্থা ঠিক তখনি ঐ দলের এক পুঁচকে ছেলে লাফ দিয়ে উঠলো। এই ধরো তোমাদেরই মত বয়স বা তারও কম। হাত পা নাচিয়ে মাথার চুল দুলিয়ে গান শুরু করলো। এক এক করে বিপক্ষ দলের সব কটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। কি তাজ্জব ব্যাপার। ঐ অতটুকু ছেলে এতকিছু জানে কারোরই বিশ্বাস হয় না। সবারই মনে উঁকিঝুঁকি মারছে নানা প্রশ্ন। এ শাহজাদা কোত্থেকে এল? কি তার পরিচয়? শাহজাদাটি কিন্তু বিপক্ষ দলের প্রশ্নের উত্তর দিয়েই ক্ষান্ত হলো না। সে নিজেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বিপক্ষ দলকে হারিয়ে দিলো। সমস্ত আসর উল্লাসে ফেটে পড়ল। পুচকে শাহজাদাটি ততক্ষণে মানুষের মাথার উপর পুতুলের মত নাচছে। দলের সরদার জিতে যাওয়ার আনন্দে বাগ বাগ হয়ে জড়িয়ে ধরলেন শাহজাদাকে। বললেন-
‘ওরে আমার ব্যাঙাচি
বড় হয়ে তুই একদিন সাপ হবি।’
সরদারের কথা কিন্তু ঘটেছিল, সে খুউব বড় কবি হয়েছিল। কি তোমরা পরিচয় জানার জন্য উসখুস করছো তাই না? অবশ্য করার কথা। তবে এসো তোমাদের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিই-তিনি হচ্ছেন আমাদের সবার পরিচিত এবং প্রিয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি আমাদের জাতীয় কবি।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম| তারা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। তার সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হল: সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”।
তোমরা হয়তো ভাবছ শাহজাদাদেরতো হাতী শালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া, পাইক, বরকন্দাজ ইত্যাদি কত কিছু থাকে, এ শাহজাদাটিরও নিশ্চয়ই আছে। আসলে এ শাহজাদার এসব কিছুই নেই। বরং বলা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত, একেবারে মিসকীনি হালত। কিন্তু হলে কি হবে? তাঁর মনটাতো আর মিসকিন নয়, একেবারে শাহজাদার শাহজাদা। ঐ যে তোমরা শুনছো না পাতালপুরির ঐ ঘুমন্ত শাহজাদার কথা। সেই যে রূপার কাঠি আর জিয়ন কাঠির পরশে রাজকন্যার ঘুম ভাঙলো! আমাদের আজকের শাহজাদা সেই পাতালপুরীতে যেতে চান কিন্তু ঐ রকম ঘুমাতে না, সবকিছুকে ভেঙে চুরে নিজের হাতের মুঠোয় নেবার জন্য। যেমন তিনি বলেছেন-
পাতাল ফুঁড়ে নামবো আমি
উঠবো আমি আকাশ ফুঁড়ে
বিশ্বজগত দেখব আমি
আপনা হাতের মুঠোয় পুরে।
মাত্র আট বছর বয়সে আব্বা মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয় তাঁকে। এ জন্য লেখাপড়ার ইতি টেনে ঐ বয়সেই কখনো মসজিদের ইমামতি, কখনো মক্তবের শিক্ষকতা করে সংসার চালাতে থাকেন। কিন্তু যারা চিরবিদ্রোহী তাঁরা চায় স্বাধীন জীবন। গ্রাম হতে চলে এসে আসানসোল শহরে রুটির দোকানে চাকরি নেন। কষ্টের কথা ছড়ায় বলতেন এভাবে-
মাখতে মাখতে গমের আটা
ঘামে ভিজতো আমার গা’টা।
এখান হতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দরিরামপুর স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ভর্তি হন রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল হাই স্কুলে। যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র ঠিক সেই সময়েই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই হাবিলদার হন। এইখান হতেই তাঁর কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। পত্র-পত্রিকায় প্রচুর কবিতা ছাপা হতে থাকে তাঁর। ১৯১৯ সালে ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধ শেষ হয়। দেশে ফিরেই লিখেন বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। কি পড়নি-
বল বীর-
বল উন্নত মম শির।
হ্যাঁ এই কবিতা আমাদের কবি শাহজাদাকে এক রাতের মধ্যেই বিদ্রোহী শাহজাদাতে পরিণত করে। এরপর দু’হাতে লিখতে থাকেন অজস্র লেখা। এ লেখাগুলোর প্রায় সবগুলিই ছিল অন্যায়, অবিচার আর শোষণের বিরুদ্ধে। সে সময়কার ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধেও তিনি শক্ত হাতে কলম ধরেন। তাঁর কলমের ডগা দিয়ে বেরুতে থাকে লকলকে আগুন। তিনি লেখেন-
এদেশ ছাড়বি কিনা বল
নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।
আরও লেখেন ‘ভাঙার গান’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘প্রলয় শিখার’ মত বিদ্রোহী কাব্য। ইংরেজ সরকার রেগে গেলেন, কবিকে ঢোকালেন জেলে। কিন্তু জেলে ঢোকালে কি হবে? তিনি সেখান থেকেই অন্যান্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে ঘোষণা করলেন-
এই শিকল পরা ছল মোদের
এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের
করবো রে বিকল।
তিনি আরো বললেন-
কারার ঐ লৌহ–কপাট
ভেঙ্গে ফেল্‌ কর্‌ রে লোপাট রক্ত –জমাট
শিকল –পূজার পাষাণ –বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় –বিষাণ ! ধ্বংস –নিশান
উঠুক প্রাচী –র প্রাচীর ভেদি’।। ইত্যাদি।
গানের ক্ষেত্রে বিদ্রোহী শাহজাদা সবার ওপরে। গানের মুকুটহীন এই সম্রাট এর রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা অন্য সকলের চেয়ে বেশি।
তিনি ছোটদের মনের কথাটা খুলে বলতে পারতেন। আর কেউ তাঁর মত সুন্দর করে বলতে পারেন নি। তাই তিনি সবার মত ছোটদেরও আত্মার আত্মীয়, একান্ত আপনজন। যেমন-
“আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।
“সুয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন’, মা বলবেন রেগে।
বলব আমি- ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল, তাই বলে কি সকাল হবে নাক’?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে ?
তোমার ছেলে উঠবে মা গো রাত পোহাবে তবে।
‘খুকু ও কাঠ বেড়ালী’ ছড়াটি কি তোমাদের মনে পড়ে? হ্যাঁ! কি যেন-
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও-
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
‘ভোর হলো’ কবিতাটি তোমাদের সবারই একান্ত প্রিয়, কি বলো? সবার মুখস্ত আছে নিশ্চয়ই-
ভোর হল, দোর খোল,
খুকুমণি ওঠ রে।
ঐ ডাকে জুঁই শাখে,
‘ফুল খুকী ছোট রে।
খুলি’ হাল তুলি’ পাল
ঐ তরী চলল।
এই বার এই বার
খুকু চোখ খুলল।
এত বড় কবি হয়েও তিনি ছিলেন খুব হাসি-খুশী ও রসিক মানুষ। হো হো করে অট্টহাসি হাসতেন। ছোটরা যে নানা দাদার সাথে হাসি তামাশা করে কবি সেটা তাঁর ‘খাঁদু দাদু’ কবিতায় সুন্দর করে তুলে ধরেছেন।
যেমন-
অমা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং।
ওঁর নাকটাকে কে করল খাঁদা র‍্যাঁদা বুলিয়ে?
চামচিকে ছা বসে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে!
বুড়ো গরুর পিঠে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং!
অমা! আমি হেসেই মরি নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং
ওঁর খ্যাদা নাকের ছেঁদা দিয়ে টুকি কে দেয় ‘টু’।
ছোড়দি বলে সর্দি ওটা, এরাম! ওয়াক থুঃ।
কাছিম যেন উপুর হয়ে ছাড়িয়ে আছেন ঠ্যাং।
অমা! আমি হেসেই মরি, নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং।
দাদুর নাকি ছিল না মা অমন বাদুড়- নাক
ঘুম দিলে ঐ চ্যাপটা নাকেই বাজতো সাতটা শাঁখ।
দিদিমা তাই থ্যাবড়া মেরে ধ্যাবড়া করেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।
বিয়ের মত খোশ খবর পেলে ছোটরা যে কি মজা পায়, নিজেরাই বিয়ে করার জন্য বায়না ধরে। ‘খোকার খুশী’ কবিতায় কবি সুন্দর করে ছোটদের মনের ভাবটা ‍তুলে ধরেছেন-
কি যে ছাই ধানাই পানাই ,
সারাদিন বাজছে সানাই।
এদিকে কারুর গা নাই
আজিনা মামার বিয়ে!
বিবাহ! বাহ কি মজা
সারাদিন গন্ডা গজা
গপাগপ খাওনা সোজা
দেয়ালে ঠৈসান দিয়ে।।
এই কবিতারই শেষে বলেছেন-
সত্যি, কওনা মামা
আমাদের অমনি জামা
অমনি মাথায় ধামা
দেবেনা বিয়ে দিয়ে?
মামীমা আসলে এ ঘর
মোদেরও করবে আদর?
বাহ! কি মজার খবর।
আমি রোজ করব বিয়ে।।
ওদিকে ‘খোকার বুদ্ধি’ কবিতা পড়লে তো হাসিতে দম আটকে আসতে চাইবে।
সাতটি লাঠিতে ফড়িং মারেন
এমনি পালোয়ান।
দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লো সেদিন
আস্ত আলোয়ান!
ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা,
তাঁরে কিনা বোকা বল? কি এর উচিত সাজা?
‘খোকার গল্প বলা’ কবিতাটাতো আরো মজার, আরো আনন্দের। বলতে গেলে তোমাদের জন্য এক থালা গরম সন্দেশ।
মা ডেকে কন, ‘ খোকন-মণি! গপ্‌প তুমি জান?
কও তো দেখি বাপ!’
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ
বললে খোকন, গপ্‌প জানি, জানি আমি গানও!’
ব’লেই ক্ষুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল-
‘একদা এক হাঁড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’
এই কবিতার অন্যত্র বলেছেন-
একদিন না রাজা-
হরিণ শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড় ভাজা
রাণী গেলেন তুলতে কলমি শাক
বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক
রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে-
হাতীর ম-মতন একটা বেড়াল বাচ্চা শিকার করে।
‘পিলে পটকা’ কবিতাটিতেও প্রচুর হাসির খোরাক মিলে-
উটমুখো সে সুঁটকো হাশিম
পেট যেন ঠিক ভুটকো কাছিম।
চুলগুলো সব বাবুই দড়ি-
ঘুসকো জ্বরের কাবুয় পড়ি।
তিন কেনা ইয়া মস্ত মাথা,
ফ্যাচকা চোখে; হন্ত? হাঁ তা
ঠিক গরিলা, লোবনে ঢ্যাঙা!
নিট পিঠে ঠ্যাং সজনে ঠ্যাঙা।
কল্পনাপ্রবণ শিশুরা কল্পনায় সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি জমায়।
যেমন-
থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে
মরছে যে বীর লাখে লাখে।
কিসের আশায় করছে তারা
বরণ মরণ যন্ত্রণাকে।
কবির এই সংকল্প কবিতাটি শিশু মনের চিরন্তন খোরাক। কবিতাটিতে শিশু মনের নানা কথা বলা হয়েছে, যা শিশুদের জন্য একান্ত আপন। কবিতাটির শেষ দু’লাইন হচ্ছে-
পাতাল ফেড়ে নামব আমি
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বজগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
অন্যত্র ‘সাত ভাই চম্পা’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
সপ্ত সাগর পাড়ি দেব আমি সওদাগর
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত-মধুকর।
সব কালের সব ধরনের শিশুদের ফলমূল চুরি করে খাওয়ার মত রোমাঞ্চকর অভ্যেস প্রচলিত আছে। আম, জাম, লিচু এগুলো তাদের কাছে লোভনীয়ও বটে। তবে এ সমস্ত কাজ নির্বিঘ্নে করা সম্ভব নয়, বিপদ আপদ এসে ঘাড়ে চাপে। সে কথাটি কবির ‘লিচুচোর’ কবিতায় অত্যন্ত নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।
তাঁর ঝিঙে ফুল কবিতা অপূর্ব ছন্দে রচিত। ছোটরা যখন কবিতা পড়ে তখন তারা ছন্দের দোলায় দুলে ওঠে-
ঝিঙে ফুল। ঝিঙে ফুল।
সবুজ পাতার দেশে
ফিরোজিয়া ফিঙে ফুল
ঝিঙে ফুল—-।
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল
ঝিঙে ফুল।।
মোটকথা কবির ছিল একটা সুন্দর শিশু মন। যে মন দিয়ে তিনি বাংলার প্রতিটি শিশুর মনের কথা বুঝতে পারতেন।
কাল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কবি লেখার কাজ বেশিদিন চালাতে পারেন নি। কলম গেল বন্ধ হয়ে, মুখের ভাষাও আর শুনতে পেলনা কেউ। এরপরও দীর্ঘ ছত্রিশ বছর বেঁচে থাকার পর আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরের পিজি হাসপাতালে ১৯৭৬ সালের ২৯শে অগাস্ট তারিখে ‘বিদ্রোহী শাহজাদা’ সবার সাথে বিদ্রোহ করে সর্বশ্রেষ্ঠ বাদশাহ সবার যিনি সৃষ্টিকর্তা সেই আল্লাহর দরবারে পাড়ি জমালেন। ইন্নালিল্লাহে ———-রাজিউন।
কবির একান্ত ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পর তার কবর যেন মসজিদের পাশে হয়।
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই তাঁকে কবর দেয়া হয়েছে। একবার এসে তোমাদের প্রিয় ‘বিদ্রোহী শাহজাদার’ কবরটি যিয়ারত করে যেও। কেমন?
Read More »

গোলাম মোস্তফা

কবি গোলাম মোস্তফা বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষক। তিনি বৃহত্তর যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমান জেলা) শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে ১৮৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কাজী গোলাম রব্বানী। মাতার মোসাম্মাৎ শরীফা খাতুন। তাঁর দাদা কাজী গোলাম সারওয়ার। গোলাম মোস্তফার পূর্বপুরুষ ছিলেন মুগল যুগে বিচার বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা। তাদের উপাধি ছিল কাজী। সেই সূত্রে গোলাম মোস্তফার পিতা, পিতামহ কাজী উপাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু গোলাম মোস্তফা নিজে কোন অর্জিত সম্মান বা প্রচলিত কৌলিণ্য প্রথার যৌক্তিকতা খুঁজে না পাওয়ায় কাজী উপাধি গ্রহণ করেননি। বহুকাল পূর্ব থেকেই মনোহর পুরের কাজী পরিবার ছিল আরবি, ফারসি ও বাংলা ভাষাতে সুপণ্ডিত। কবি গোলাম মোস্তফার জন্মসাল নিয়ে একটু কথা আছে। তিনি নিজেই “আমার জীবন স্মৃতি” তে লিখেছেন: ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে আমার জন্ম। কিন্তু আমার মনে আছে শৈলকুপা হাইস্কুলে ভর্তি হবার সময় আমার আব্বা আমার বয়স প্রায় দুই বছর কমিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই প্রকৃত জন্ম হয়েছিলো সম্ভবত ১৮৯৫ খৃস্টাব্দে। তবে এটা ঠিক যে, বাংলা তারিখ ছিলো ১৩০৪ সালের ৭ ই পৌষ রবিবার।কবির স্মৃতিকথা থেকেই আমরা কবির সঠিক জন্ম সন, বাংলা মাসের হিসেব এবং দিনের নাম রবিবার পাই। কিন্তু ইংরেজি মাসের হিসেবটা উহ্য থেকে যায়। তাঁর সঠিক জন্ম তারিখটা পরিবার থেকে সংরক্ষণ করা হয়নি। কবির পিতার দুই স্ত্রীর মধ্যে প্রথম স্ত্রীর গর্ভে বড়– নামে এক কন্যা এবং কাজী গোলাম মোস্তফা ও কাজী গোলাম কাওসার নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তিনটি সন্তান তাঁরা যথাক্রমে কাজী গোলাম কুদ্দুস, মাজু এবং খুকি। কাজী গোলাম মোস্তফাই আমাদের প্রিয় কবি গোলাম মোস্তফা। এই পরিবারের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার নিবেকৃষ্ণ পুর গ্রামে। কবির মাতা ছিলেন একজন স্বভাব কবি। স্বভাব কবিত্ব ব্যক্তি মায়ের সাথে থেকে কবির মধ্যেও কবিত্ব ভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের আশা আকাঙ্খা ও স্বপ্নের পথিকৃত শিশুদের নিয়ে এমন শাশ্বত ও চিরন্তন বাণী সিঞ্জিত লেখা যার কলমের ডগায় বেরিয়ে আসে, তিনিই ইসলামী রেনেসাঁর এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ স্বর কবি গোলাম মোস্তফা।
কৈশোর ও বাল্য জীবন
কবির বাল্য জীবন নিজ গ্রাম মনোহর পুরেই কেটেছে। কুমার নদী বিধৌত মনোহরপুর গ্রামের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, সরল আতিথিয়তা বাৎসল্য গায়ে মেখেই কবি বেড়ে উঠে ছিলেন।তাঁর জন্মস্থান মুখরিত ছিল যমুনা, কুমার মধুমতি, চিত্রা, ভৈরব, ভদ্রা চন্দনা, নবগঙ্গা, হানু বারাসিয়া, মাথাভাঙ্গা আর কপোতাক্ষ প্রভৃতি সেকালের খরস্রোত নদীর কলতানে। বাংলাদেশে বোধকরি আর কোন জেলায় এত নদীর রূপালী ধারার মিলন ঘটেনি। এসব বহমান নদীর তীরে নারকেলÑখেজুর কুঞ্জ ঘেরা শ্যামল প্রকৃতি যে কোন ভাবুক মানুষের মনে সঞ্চার করে কাব্যকলার মাধুরি। এ গ্রামীন পাগলকরা সৌন্দর্যই শিশু গোলাম মোস্তফাকে ভাবুক করে গড়ে তোলে ও কবি হতে সাহায্য করে। কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
শারদ প্রভাত চাদিনীর রাত সুপ্তি নীরব ধরা
আতট পূরতি সরসী সলিল পদ্ম পানায় ভরা।
কলমী লতিকা ডাঁটায় ও পাতায় ছাইয়া ফেলেছে জল
মাঝে মাঝে তার নানান রঙের ফুটেছে পুষ্পদল।
এই কবিতায় কবি তাঁর চারপাশের নদী প্রকৃতির এক অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে কাব্যরস পিপাসুকে উপহার দিয়েছেন নিটোল ছন্দ সৌকর্ষ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময়তা। কবিতার মতই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মোহনীয় রূপ গায়ে মেখেই কবির শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো অতিবাহিত হয়। গ্রামের স্নিগ্ধ শ্যামল সৌন্দর্যই তাঁর প্রাণে প্রথম কবিত্বভাব জাগিয়েছিলো। বস্তুত এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশই ছিল A meet nurse for a Poetic Child তাইতো পরিণত বয়সে তিনি লিখতে পেরেছিলেন:
নিখিলের এত শোভা, এত রূপ, এত হাসি গান
ছাড়িয়া মরিতে মোর কভু নাহি চাহে মন প্রাণ।
এ বিশ্বের সবই আমি বাসিয়াছি ভালো
আকাশ বাতাস জল রবি শশী তারকার আলো।
প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজ সরল মাটির গন্ধে বেড়ে উঠার কারণেই সারা জীবন কবির মধ্যে সরলতাবোধ, সম্প্রীতিবোধ, আতিথিয়তাবোধ, মানবতাবোধ তার ব্যক্তিত্বের সাথে মিশে ছিলো। কবি হতে পেরেছিল উদার ও সরলতার প্রতিক এক মানসভূমি। কিন্তু কবির বেড়ে ওঠার জীবনটা মোটেই স্বচ্ছন্দ ছিলো না। অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তাকে সাফল্যের মুখ দেখতে হয়েছিল। কবি কন্যা ফিরোজা খাতুন লিখেছেন: আমার আব্বা কবি গোলাম মোস্তফার হাতের লেখার মত তাঁর ভাষাও অতি সুন্দর ও মিষ্টি স্বচ্ছন্দ গতি একটুও বাধে না কোথাও। কিন্তু তাঁর জীবন অত সহজ ও স্বচ্ছন্দ ছিল না। তাঁর জ্ঞান পিপাসিত প্রতিভার তরীকে উজান পথে অনেক ঝড় ঝাপটার মুকাবিলা করে বেয়ে নিতে হয়েছে লক্ষ্যস্থলে। শৈশব কালেই সৎমা থাকায় স্বভাবতই বাপের অবহেলায় কখনও মামার বাড়ি কখনও নিজের বাড়ি থাকতে হতো। আর্থিক অনটনে শৈশবেই টিউশনি করতে হতো, তারপরও ক্লাসে ফাষ্ট হয়েছেন। তার জীবনকে সংগ্রামের মধ্যে পরিচালিত করার মাধ্যমে শৈশবের সে সংগ্রাম তিনি কাটিয়ে উঠে ছিলেন। জীবনকে সাজিয়েছিলেন বর্ণাঢ্যতায়। নিজ যোগ্যতা ও মেধার কারিশমায় চলমান জীবনকে করেছিলেন উচ্চকিত দ্যুতিময়।
শিক্ষা জীবন ও মানস গঠন
শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগের কারণেই মাত্র চার বছর বয়সেই পিতা মুন্সি গোলাম রব্বানীর কাছে কবির লেখা পড়ার হাতে খড়ি হয়েছিল। মনোহরপুরের পাশ্ববর্তী দামুদিয়া গ্রামের পাঠ শালাতে প্রথমে শিশু গোলাম মোস্তফাকে ভর্তি করা হয়। এখানে কিছুদিন লেখাপড়ার পর কবিকে নিকটবর্তী ফাজিলপুর গ্রামের পাঠ শালাতে ভর্তি করা হয়।
ফাজিলপুর পাঠ শালায় দুই বছর লেখাপড়া করবার পর তাঁকে ভর্তি করা হয় শৈলকুপা হাই স্কুলের নীচের শ্রেণীতে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করে পুরস্কৃত হন।
শৈলকুপা স্কুল থেকেই তিনি ১৪১৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খুলনার দৌলতপুর কলেজ হতে ১৯১৬ সালে আই. এ. পাশ করেন। এরপর গোলাম মোস্তফা উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তদানীন্তন বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কোলকাতা গমন করেন। ১৯১৮ সালে তিনি কোলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন। ঐ কলেজ থেকে ঐ বছর যশোরের কৃতি সন্তান মোহাম্মদ গোলাম হোসেন (১৮৭৩Ñ১৯৬৪ খৃ.) বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসেবে বি.এ. পাশ করেন। লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (১৮৯৪Ñ১৯৫০ খৃ.)ও রিপন কলেজে পড়াকালীন সময়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন।
আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাঁর আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করার পর ১৯২২ সালে গোলাম মোস্তফা ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. টি. পাশ করেন। এরপর আর কোন একাডেমিক ডিগ্রী অর্জন না করলেও সারা জীবন শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষা অর্জনের পেছনেই ব্যয় করেছেন।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে যে সময়ের বৃত্তে কবি গোলাম মোস্তফার জন্ম হয়, সেই সময়টা বাঙালী মুসলমানদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়Ñকারণ এই পর্বে অন্তত: তিনটি ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতির মাত্রা ছিল অত্যন্ত দ্রুত। এগুলো হল: শিক্ষা, রাজনীতি এবং আর্থিক। অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের কোন প্রভাব ছিল না।বিশ ও ত্রিশ দশকে কৃষক প্রজাপার্টির অভ্যূদয় (১৯১৯ খৃ.), বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে মুসলমান নেতাদের বিজয় (১৯৩৭ খৃ.) এসবই বাঙালী মুসলমানদের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। মুসলমানদের মধ্যে এর আগে যাঁরা নেতৃত্ব পদে ছিলেন তাঁরা প্রধানত অবাঙালী। বাঙালী সংস্কৃতি ও ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে সমন্বয়ের সুযোগ ছিলো, বরাবরই তাঁরা তা এড়িয়ে গেছেন। বরং বাঙালী মুসলমানদের উপর ইসলামী সংস্কৃতির নামে যা চাপানোর চেষ্টা করেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে আরব ও পারস্য দেশের সংস্কৃতি। এ সময়কালে বাঙালী মুসলমানরা বহু মাসিক অর্ধমাসিক ও সাপ্তাহিক পত্র পত্রিকা প্রকাশে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং সীমিত পর্যায়ে হলেও তাতে উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদীতার স্থান পেতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটই কবি গোলাম মোস্তফার বেড়ে ওঠা এবং তাঁর মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
চাকুরি জীবন
বি.এ পাস করার পর তিনি ১৯২০ সালে ব্যারাকপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই স্কুলে থাকা অবস্থায় তিনি ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯২৪ সালে তিনি ব্যারাকপুর স্কুল থেকে কলকাতার হেয়ার স্কুলে বদলি হন। সেখানে তিনি একটানা নয় বছর শিক্ষকতা করার পর কলিকাতা মাদ্রাসায় বদলী হন এবং এক সময় তিনি প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। উল্লেখ্য যে, আজ পর্যন্ত একমাত্র কবি গোলাম মোস্তফা ছাড়া অন্য কোন মুসলমান শিক্ষক বালিগঞ্জ স্কুলের উক্ত পদে আসীন হননি। তিনি ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে একজন উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক।তৎকালে কলিকাতার কোন হাই স্কুলে গোলাম মোস্তফাই ছিলেন প্রথম মুসলমান হেডমাস্টার। তখনকার দিনে এই সম্মান খুব কম মুসলমানই পেয়েছেন। সেখান থেকে কবিকে বদলী করা হয় হুগলী কলেজিয়েট স্কুলে। এরপর ১৯৪০ সালে তাঁকে বাকুড়া জেলা স্কুলে বদলী করা হয়। এ সম্পর্কে কবি কন্যা ফিরোজা খাতুন লিখেছেন: এরপর আব্বা বাঁকুরায় জেলা স্কুলে বদলি হলেন। কলকাতা মানুষের সমুদ্রের মাঝে যেমন জ্ঞানের মুক্তা কুড়াবার আনন্দ পেয়েছেন, তেমনি হুগলীতে নদীর স্রোত বইয়েছেন বিশ্বনবীর প্রবাহে। দেশের বাড়িতে পেতেন সমতার মমতার বিস্তার। বাঁকুড়ার পাহাড় পর্বত ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে কবিকে। সুষনিয়া পাহাড়ে পিকনিকে গিয়ে চূড়ায় বসে কবিতা লেখেন, গান করেন। সেখান থেকে ফরিদপুর বদলি হয়ে যান।
১৯৪৬ সালে তাকে সর্বশেষ ফরিদপুর জেলা স্কুলে বদলী করা হয়।ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকেই তিনি ১৯৫০ সালে দীর্ঘ ত্রিশ বছর একটানা শিক্ষকতার মত মহান পেশার দায়িত্ব পালন করার পর স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।তিনি পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলা ভাষা কমিটির সচিবরূপে কাজ করেন। ১৯৫০ সালে কবি গোলাম মোস্তফা অবসর গ্রহণ করেন এবং নিজের খরিদ করা বাড়ি ঢাকার শান্তিনগরে ১১৮, মোস্তফা মঞ্জিলে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন।
একান্ত নিবিড়ভাবে সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করার জন্যই তিনি নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগেই শিক্ষকতার মহান পেশা থেকে অবসর নেন।
সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা
কবিতা কবির কল্পনা, কবিতা কবির শৈল্পিক উচ্চারণ। কবিতার শিল্পরূপ থেকেই কবির সময়চেতন সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, মিলন বিরহ, স্বপ্ন দ্রোহ ইত্যাদির শিল্পমণ্ডিত প্রকাশ। একই কবিতায় সব রকম অনুভূতি থাকে না, কারণ কবির কবিতায় বিশেষ সময়ে বিশেষ চেতনায় প্রকাশিত হয় বিশেষ বিশেষ ভাব। কবি কল্পনায় ধরা পড়ে সেই ভাব, আপন কবিতার ভাষায় কবি তাকে শিল্পরূপ দেন।
কবি কল্পনার উৎস তাই সমাজ, এবং প্রকাশভঙ্গিতে থাকে তার সময়চেতনা। কবিতায় কবি যা বলতে চান তা পরিবেশ ও অবস্থানগত দ্বিধার কারণে কিংবা যে সমাজ কবি চান, আর যে সমাজে কবি বাস করেন, তার মধ্যের ব্যবধানে অতৃপ্ত ও অসহিষ্ণু হয়ে এমন ভাষা ব্যবহার করেন, যা আঙ্গিকগত উৎকর্ষ পায়।
ভাব আর রূপের এক অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য ঐক্য থেকে জন্ম নেয় একটি কবিতা। এ কবিতা কবি রচনা করেন আপন মহিমায়। জীবনের সত্যকে তিনি যেভাবে আপন সত্ত্বায় ধারণ করেন, সেভাবেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় কবিতার প্রকাশভঙ্গি, শৈলী ও রূপ। সৃষ্টিসম প্রজ্ঞা, জৈবিক ক্ষমতা, সমাজ ও সময়ের প্রভাবের সমন্বয়ে কবির মর্মভূমি কবিতা নির্মাণে অদৃশ্য শক্তির মত কাজ করে যায় এমনকি কবির অজ্ঞাতসারে। তেমনি নিতান্ত অজ্ঞাতে অন্তরালে শিশু বয়সেই কবির মধ্যে কাব্য চিন্তার উন্মেষ ঘটে। পিতা, পিতামহের পুঁথি পাঠ , বিয়ের দাওয়াত রচনা ইত্যাদি থেকে তাঁর মধ্যে কবিত্ব ভাব জেগে ওঠে। মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি গোলাম মোস্তফার অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত।গোলাম মোস্তফা ছিলেন মূলত: কবি। কবি আমার জীবন স্মৃতিতে লিখেছেনÑ আমার বেশ মনে পড়ে, আমার কাব্য জীবনের প্রথম উন্মেষ হয় ১৯০৯ সালে। তখন আমি শৈলকুপা হাইস্কুলে পড়ছি। পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবার পরই কেমন যেন একটা কাব্যিক ভাব আমার মধ্যে এলো।
১৯১১ সালে কবি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটি কাটানোর পর তাঁর এক বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি কবিতায় রচনা করেন। এটিই তাঁর প্রথম রচনা । কবিতাটি হল :
এস এস শীঘ্র এস ওহে ভ্রাতধন
শীতল করহ প্রাণ দিয়া দরশন।
ছুটি ও ফুরাল স্কুল ও খুলিল,
তবে আর এত দেরি কিসের কারণ।
পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম কবিতার নাম আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার (১৯১৩ খৃ.)। কবি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। প্রখ্যাত সাংবাদিক মওলানা মুহম্মদ আকরাম খাঁ সম্পাদিত সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী তে ১৯১৩ সালে কবিতাটি ছাপা হয়। কবিতাটির রচনা ও প্রেক্ষাপটের বর্ণনা করতে গিয়ে কবি বন্দে আলী মিয়া লিখেছেন,পারিপার্শি¦ক পরিবেশ এবং বন্ধুবর্গের প্রেরণায় গোলাম মোস্তফার অবরূব্ধ কাব্যপ্রবাহ ঝর্ণাপ্রবাহের মত বাইরে আত্মপ্রকাশ করল। সেই সময়ে ইউরোপ ভূÑখন্ডে বলকান যুদ্ধে তুরস্ক সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ানদের হাতে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হওয়ায় সমস্ত মুসলিম জাহানে একটা বিপর্যয়তার ছায়া নেমে এসেছিলো। এমন সময়ে হঠাৎ সংবাদ পাওয়া গেল, কামাল পাশা বুলগেরিয়ানদের নিকট থেকে আদ্রিয়ানোপল পুনরূদ্ধার করেছেন। এই খবরে স্বজাতি বৎসল কিশোর কবির প্রাণ আনন্দে নেচে উঠলো। তিনি আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার নাম দিয়ে এক রাতের মধ্যে একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা লিখে ফেললেন। এরপর কবিতাটি তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মাদিতে পাঠিয়ে দিলেন। পরবর্তী সপ্তাহে কবিতাটি মুদ্রিত হলো। কবিতাটি ছিলো এরূপ :
আজিকে প্রভাত কি বারতা নিয়া
ধরায় আসিলো নামিয়া।
সেই সময় কবিতার ছন্দ, ভাব এবং প্রকাশভঙ্গি সবই ছিলো নতুন। তাই এই কবিতাকে কেন্দ্র করে পাঠক মহলে একটা ব্যাপক আলোচনার ঝড় বয়ে গেল।বাংলার মুসলিম সমাজে যে একজন আধুনিক কবির আবির্ভাব হয়েছে একথা সহজেই স্বীকৃতি লাভ করলো। গোলাম মোস্তফাও নব ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন। সেই থেকে তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে শুরু করলেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (১৯১৭ খৃ.), আল এসলাম (১৯১৫ খৃ.), সাধনা ( ১৯১৬ খৃ.), সহচর ( ১৯১৫ খৃ.), সওগাত ( ১৯১৭ খৃ.), মাসিক মোহাম্মদী (১৯১৬ খৃ.), ইসলাম দর্শন (১৯২৭ খৃ.), মাহে নও সত্য বার্তা (১৯৩৮ খৃ.), মোয়াজ্জিন ( ১৯৩৮ খৃ.) প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকায় এসব কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। আল এসলাম (২য়ভাগ, ১৩২৩ সাল), (তয় ভাগ, ১৩২৪ সাল), (৪র্থ ভাগ, ১৩২৫ সাল), (৫ম ভাগ, ১৩২৬ সাল) পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
মৌলিক রচনা এবং পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজী সাহিত্যেও তাঁর প্রচুর দক্ষতা ছিল। সমসাময়িক The Musalman, The star of India, The Morning News, The Pakistan Observer, The Down প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি অনেক তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এগুলো পাঠ করলে ইংরেজী ভাষার উপরও যে কবির যথেষ্ট দখল ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
Morning News তাঁর সর্ম্পকে মন্তব্য করেছিলো He is also a fine prose writer both in Bengali and English. বাঙালী মুসলমানের জাতীয় জাগরণের পথিকৃতদের অন্যতম কবি গোলাম মোস্তফা জীবনের প্রথম থেকেই পরিকল্পিতভাবে তাঁর লেখনি চালনা করেন।
তিনি নিজেই লিখেছেন: “যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানের অবক্ষয়ের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যের না ছিলো কোন স্বাতন্ত্র, না ছিলো কোন স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির মননশক্তি, ঐতিহ্য, ধ্যান ধারণা ও আশা আকাংক্ষা রূপায়িত হয় তাঁর মাতৃভাষার মধ্যে। সেই হিসেবে বাংলার মুসলমানদের কোন সাহিত্যই তখন রচিত হয়নি। আমি তাই ছোটবেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলিমের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও, আমার মনে জেগেছিলো আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দূর্জয় আকাঙ্খা। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তাগিদে নয়Ñসহজ ভাবেই আমি বাংলা সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামী কৃষ্টির রূপায়ণ।”
উক্ত দৃষ্টি ভঙ্গিকে সামনে রেখেই ১৯১৩ সালের প্রথম লেখা প্রকাশ থেকে তাঁর পরবর্তী পঞ্চাশ বছরকাল তাঁর লেখালেখির গতি অব্যাহত ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুতোষ সাহিত্য, গান, জীবনী, অনুবাদ সাহিত্য লিখেছেন। পেশাগতভাবে একজন শিক্ষক গোলাম মোস্তফা তাঁর দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার কল্যাণেই শিশু ও কিশোর মনস্তত্ত্বের সংগে ছিলেন নিবিড়ভাবে পরিচিত। এ কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে বহু স্মরণীয় শিশু ও কিশোরÑকবিতা রচনা। তাঁর রচিত আলোকমালা (১৯৫৩ খৃ.), পথের আলো (১৯৫৩ খৃ.), নতুন আলো (১৯৫৪খৃ.) এবং আলোকমঞ্জুরী (১৯৫৪খৃ.) সিরিজগুলো শিশু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান।
ধর্ম বিশ্বাসই গোলাম মোস্তফার চিন্তার ভিত্তিভূমি। জগত ও জীবনের প্রতিটি সত্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রগাঢ় ইসলামী ভাবধারায় সম্পৃক্ত।গোলাম মোস্তফার সর্বশ্রেষ্ট অবদান বিশ্বনবী (১৯৪২ খৃ.) বহুল সমাদৃত। তাঁর লেখালেখির পঞ্চাশ বছরে প্রকাশিত
দুইটি উপন্যাস
১. রূপের নেশা (উপন্যাস, ১৩২৬ খৃ.), ২. ভাঙ্গা বুক (উপন্যাস, ১৯২১ খৃ.)।
আটটি মৌলিক কাব্য
১. রক্ত রাগ (কবিতা, ১৯২৪ খৃ.), ২. খোশরোজ (কবিতা, ১৯২৯ খৃ.), ৩. সাহারা (কবিতা, ১৯৩৫ খৃ.), ৪. হাস্না হেনা (কবিতা, ১৯২৮খৃ.), ৫. কাব্যকাহিনী (কবিতা, ১৯৩৮ খৃ.), ৬. তারানা ই পাকিস্তান (কবিতা, ১৯৫৬ খৃ.), ৭. বনি আদম, প্রথম খণ্ড (কবিতা, ১৯৫৮ খৃ.), ৮. আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি (কিশোর কবিতা, ১৯৮০ খৃ.)।
৫ টি কাব্যানুবাদ ও ১টি গল্প সংকলন
১. মোসাদ্দস ই হালী (অনুবাদ কবিতা, ১৯৪১ খৃ.), ২. কালাম ই ইকবাল (কবিতা, ইকবাল কাব্যের অনুবাদ, ১৯৫৭ খৃ.), ৩. শিকওয়া (অনুবাদ কবিতা, ১৯৬০ খৃ.), ৪. জবাব ই শিকওয়া (অনুবাদ কবিতা, ১৯৬০ খৃ.), ৫. আল কুরআন (বাংলা কাব্য অনুবাদ, ১৯৫৭ খৃ.), জয় পরাজয় (গল্প, ‘রাসাইলু ইখওয়ানুস্ সাফা ১৯৬৯ খৃ. ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ)।
৩টি কাব্য সংকলন
১.বুলবুলিস্তান (কাব্য সংকলন, ১৯৪৯ খৃ.), ২. কাব্য গ্রন্থাবলী, ১ম খণ্ড (কবিতা আবদুল কাদির সম্পাদিত, ১৯৭১ খৃ.), ৩. কাব্য সংকলন (কবিতা সৈয়দ আলী আশরাফ সম্পাদিত, ১৯৬০ খৃ.)।
৪টি জীবনী গ্রন্থ
১.বিশ্বনবী (জীবনী, ১৯৪২ খৃ.), ২. মরু দুলাল (জীবনী, ১৯৪৮ খৃ.), ৩. বিশ্ব নবীর
বৈশিষ্ট্য (জীবনী, ১৯৬০ খৃ.), ৪. হযরত আবুবকর (জীবনী, ১৯৬৫ খৃ.)।
২টি ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ
১. ইসলাম ও জিহাদ ( ১৯৪৭ খৃ.), ২. ইসলাম ও কমিউনিজম (ধর্ম, ১৯৪৯ খৃ.)।
৩টি রাজনীতি ও ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ:
১. ইতিহাস পরিচয় (রাজনীতি, পাঠ্য, ১৯৪৭ খৃ.); ২. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (রাজনীতি, তা: বি:)। ৩.অবিস্মরণীয় বই, (ইতিহাস সম্পাদনা, ১৯৬০ খৃ.);
১টি প্রবন্ধ সংকলন:
আমার চিন্তাধারা (প্রবন্ধ সংকলন, ১৯৬২ খৃ.), ও
১টি গানের সংকলন:
গীতি সঞ্চয়ন (গান, ফিরোজা খাতুন সম্পাদিত: ১৯৬৫ খৃ., ১৯৬৮ খৃ. )।
পাঠ্য পুস্তক :
আলোক মঞ্জরী, (১৯৫৩ খৃ.), পথের আলো (১৯৫৩ খৃ.), নতুন আলো (১৯৫৪খৃ.), ইসলামী নীতিকথা (১৯৫৩ খৃ.), মনিমুকুর, ইতিহাস পরিচয় (১৯৪৭ খৃ.), ইতিকাহিনী, নতুন বাংলা ব্যকরণ, নতুন ব্যকরণ, মঞ্জু লেখা ইত্যাদি।
গ্রন্থসমূহ থেকেই বোঝা যায় কবি গোলাম মোস্তফা শুধু একজন কবিই ছিলেন না, সাহিত্যের নানা শাখায় ছিলো তাঁর স্বতস্ফূর্ত বিচরণ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন চৌকষ লেখক। তাঁর অবদান সাহিত্যের নানা শাখায় পল্লবিত হয়ে আছে। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, সাহিত্য, জীবনী, গবেষণা, পাঠ্যপুস্তক, চিন্তাধারাসহ সাহিত্যের সকল বিভাগে তাঁর অবদানঅপরিসীম। তিনি তাঁর কাব্যের বিরাট একটা অংশ, গদ্যের বেশির ভাগ জুড়ে ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যয় করে গেছেন। ইসলামী ঐতিহ্য চেতনায় নিজেকে ব্যপ্ত রেখেছেন। কবি গোলাম মোস্তফার প্রতিভা শুধু লেখনি মুখেই প্রকাশ পায়নি, তাঁর সাহিত্য রচনায় তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর শেষ অবদান হযরত আবু বকর সিদ্দিক [রা.] এর জীবনী। একজন কবি, একজন সাহিত্যিক, একজন প্রবন্ধকার, একজন জীবনীকার, একজন উপন্যাসিক, একজন গীতিকার, সর্বোপরি একজন লেখক হিসেবেএখানেই তিনি সার্থক।
তাঁর রচিত শিশুদের মন মাতানো অসংখ্য ছড়া/কবিতা ইত্যাদি রয়েছে-
ক. আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।
  ……………………………………..
 ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।(কিশোর)।
খ. খুকুমনি জনম নিল যেদিন মোদের ঘরে,
  পরীরা সব দেখতে এল কতই খুশী ভরে। (কিশোর)।
গ.  এই করিনু পণ মোরা এই করিনু পণ
ফুলের মতো গড়ব মোরা মোদের এই জীবন।
হাসব মোরা সহজ সুখে   গন্ধ রবে লুকিয়ে বুকে
মোদের কাছে এলে সবার   জুড়িয়ে যাবে মন। (শিশুর পণ)।
ঘ.  নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।
রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছ ধুম,
বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম।
*****************************
  ধূলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাদার পিঠে,
মিছিমিছি খেয়া সবাই, বলে- বেজায় মিঠে।
এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে,
পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে। (বনভোজন)।
বিটিভির এক সময়ের জনপ্রিয় ‘নতুন কুঁড়ি’র সূচনা সঙ্গীত কবির কিশোর কবিতা হতেই নেওয়া হয়েছে।
কবি গোলাম মোস্তফা আমাদের সকলের মনমত করে সূরা ফাতিহার ছন্দোবদ্ধ ভাবানুবাদ লিখেছেন,
অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি
বিচার দিনের স্বামী।
যত গুণগান হে চির মহান
তোমারি অন্তর্যামী।
তাছাড়া তাঁর লেখা হামদ, নাত আমাদের দেশের ছেলে বুড়ো সকলের প্রিয়।
তাঁর প্রকাশিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলি হচ্ছে রক্তরাগ, হাস্নাহেনা, খোশরোজ, সাহারা, কাব্যকাহিনী, এবং অনুবাদগ্রন্থ মুসাদ্দাসই হালী, তারানা ই পাকিস্তান, বনি আদম, অনুবাদ কাব্য-আল কুরআন, কালামে ইকবাল ও শিকওয়াও জবাব ই শিকওয়া এবং কবিতা সংকলন বুলবুলিস্তান। এছাড়া লিখেছেন ‘বিশ্বনবী’র মত পাঠক নন্দিত বিশালাকার গদ্য গ্রন্থ। তিনি কবি আল্লামা ইকবালের গোঁড়া ভক্ত ছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি নজরুল ইসলামকে নিয়ে এ ছড়াটি লিখেছেন-
কাজী নজরুল ইসলাম
বাসায় একদিন গেছিলাম
ভায়া গান গায় দিনরাত
সে লাফ দেয় তিন হাত
প্রাণে হর্ষের ঢেউ বয়
ধরার পর তার কেউ নয়।
তিনি বাংলা একাডেমী, টেক্সট বুক বোর্ড, করাচীর বুলবুল একাডেমী, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি(১৯৪৯), পাকিস্তান জাতীয় গ্রন্থাগারের গভর্নিং বডি এবং পাকিস্তান লেখক সংঘের সদস্য ছিলেন।
১৯৬০ সালে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব, প্রেসিডেন্ট পদক ও আরো পাঁচ হাজার টাকা নগদ পুরস্কার লাভ করেন। ঐ ১৯৬০ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-পাক সাংস্কৃতিক সম্মেলনে এবং ১৯৬১ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর অধিবেশনে তিনি পাকিস্তানী লেখকবৃন্দের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৩ অক্টোবর ১৯৬৪ সালে সেরিব্রাল থ্রম্বসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই মহান কবি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাঁর রূহের মাগফিরাত দিন।
Read More »

শেখ হবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতি চিন্তা ও চর্চার একটা গঠনমূলক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। মীর মোশাররফ হোসেন(১৮৪৭-১৯৯১), মোজাম্মেল হক(১৮৫০-১৯৬১), কায়কোবাদ(১৮৫৮-১৯৫১) যে ধারার সূচনা করেছিলেন পরবর্তীতে মুনসী মুহম্মদ মেহেরউল্লা (১৮৬১-১৯০৭), ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৭৯-১৯৩১), শেখ ফজলুল করীম (১৮৮২-১৯৩০), শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন (১৮৯১-১৯৬২) প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক, সংগ্রামীগণ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে এগিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের তুলনায় অনগ্রসর মুসলমানদের স্বরূপ সন্ধান, স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ ও তাদের জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করতে। এ ক্ষেত্রে তারা সব দিক হতে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মুসলিম জাতীয় জাগরণের পথিকৃত মুনসী মেহেরউল্লার নিকট হতে। মুনসী মেহেরউল্লা বুঝতে পেরেছিলেন পরাধীন দেশে বৈরী শাসনাধীনে মুসলমান সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজন তাদের মধ্যে নবজাগরণের। আর এ নব জাগরণ সম্ভব করার জন্য তিনি নিজে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখালেখির সাথে সাথে গড়ে তুলেছিলেন একটি সাহিত্যিক সম্প্রদায়।
“শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ছিলেন সেই সাহিত্যিক সম্প্রদায়েরই একজন। তাঁর জীবন সাধনার আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল বাঙালী মুসলমানের জন্য সম্মানজনক ও শ্রদ্ধাশীল আত্মপরিচয় নির্মাণে সহায়তা করা। ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্য ভিত্তিক নবজাগরণমূলক কাব্য রচনা, ভারতবর্ষের মুসলমানদের গৌরবময় অতীত ও প্রেরণাদায়ক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা, ধর্মীয় চেতনা ও মননশীলতা বিকাশে ‘সহায়ক সমৃদ্ধশালী বিদেশী সারাবান সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ ও দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের চরিত-মানস গঠন উপযোগী শিশুতোষ সাহিত্য রচনার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে একটি নব চেতনা জাগৃতির প্রত্যাশী ছিলেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী কালব্যাপী শিক্ষকতা জীবনের পাশাপাশি তাঁর সৃজনশীল সাহিত্য সাধনার মধ্যে সংকীর্ণতা রহিত মুক্তবুদ্ধি সঞ্জাত সম্প্রদায়গত সমৃদ্ধি কামনা ও সমাজ হিতৈষণার পরিচয় পাওয়া যায়।”(শেখ হবিবর রহমান-মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, পৃ.৯)।
শেখ হবিবর রহমান নিজের সাহিত্য সাধনা সম্বন্ধে ‘আমার সাহিত্য জীবন’ গ্রন্থের ১০৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
“আমার সাহিত্য বরাবর মোল্লা ধরনের; এইজন্য ইহা অনেকের নিকট উপেক্ষিত। নিয়ামত, আবেহায়াত ইত্যাদি ধরনের পুস্তকের নাম বোধ হয় মুসলমান সমাজে সর্বপ্রথম আমিই রাখিয়াছি। এতদ্ব্যতীত আমার বিবিধ পুস্তকে আরবী, ফারসী শব্দের ব্যবহার এত অধিক যে, আমাদের মধ্যে আর কেহই তত অধিক শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন কিনা সন্দেহ। জাতীয়ভাবে জাতীয় শব্দের সংমিশ্রণে জাতীয় সাহিত্যের সৃষ্টি আমার জীবনের প্রধান একটি সাধনা।”
শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ১৮৯০ মতান্তরে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তদানিন্তন যশোর জেলার বর্তমান মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলাধীন ঘোষগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ দেরাজতুল্লাহ এবং দাদার নাম শেখ হেরাজতুল্লাহ। জানা যায় আরব দেশ হতে তাঁর পূর্ব পুরুষ এদেশে এসেছিলেন এবং ঘোষগাতি গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
শেখ হবিবর রহমানরা দুই ভাই ছিলেন। তাঁর ছোটভাই শেখ ফজলর রহমানও একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা ও ধর্ম প্রচার করে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে ‘পুলুম আঞ্জুমানে হেমায়তুল ইসলাম’ নামক ধর্মীয় সামাজিক সংগঠনের সম্পাদক ও ‘আলমগীর লাইব্রেরীর পক্ষে বড় ভাই শেখ হবিবর রহমানের বেশ কয়েকখানি পুস্তক প্রকাশ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
শেখ হবিবর রহমানের লেখাপড়া গ্রামের পাঠশালায় শুরু হয়। পরে পুলুম প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে উচ্চ প্রাথমিক পাঠ শেষ করে তিনি ফুলতলা ইউনিয়ন হাইস্কুলে ভর্তি হন। আরও পরে ১৯০৭ সালে সেখান হতে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে ১৯১০ সালে যশোর জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশের আগেই ১৯০৯ সালে তাঁর স্নেহময়ী পিতা ইন্তিকাল করেন। এজন্য তাঁর শিক্ষাজীবন দারুণ অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। পিতৃবিয়োগের পর তাঁকে বহু কষ্টে তাঁর যাবতীয় খরচ নির্বাহ করতে হত। ১৯১৪ সালে তিনি বি.এ. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এখানেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বি.এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি যশোর জেলা স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আরও পরে ১৯২২ সালে কলকাতা ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে এল.টি. ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালে এল.টি. পাশ করেন।
ঐ বছরই তিনি বারাসাত গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। নয় মাস পরে তাঁকে মক্তব সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে খুলনায় বদলী করা হয়।
শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্নকে ১৯২৭ সালে খুলনা হতে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলে বদলী করা হয় এবং সেখানে ৪ বছর চাকুরী করার পরে ১৯৩০ সালে পুনরায় তাকে বারাকপুর সরকারী হাইস্কুলে বদলী করা হয়। এই স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৪ সালে তিনি চাকরী হতে অবসর গ্রহণ করেন।
খুলনা শহরে অবস্থানকালে তিনি পুনরায় ১৯৫১ সালে করোনেশন বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পদে যোগদান করেন এবং কর্মজীবন হতে দ্বিতীয়বারের মত ১৯৬০ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায়ই তাঁর মধ্যে সৃজনশীল রচনার প্রেরণা দেখা যায়। এই সময়ে তিনি ‘গো-জাতির প্রতি অত্যাচার’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। পয়গ্রাম কসবা মাইনর স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় মুনসী মুহম্মদ মেহেরউল্লা এক ধর্মসভায় গেলে সেখানে তিনি দুটি কবিতা পাঠ করেন। কবিতা দু’টি শুনে মুনসী মেহেরউল্লা তাঁকে ‘শিশুকবি’ খেতাবে ভূষিত করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘পেচক পন্ডিত’ নামের একটি কবিতা। কবিতাটি ১৩১৪ সনের ১৫ আশ্বিন ‘মোসলেম সুহৃদ’ এবং ১৮ আশ্বিন ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় ছাপা হয়।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯০৬ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘কোহিনুর কাব্য’। ফুলতলা(খুলনা) জুনিয়র মাদ্রাসার সেক্রেটারী মৌলভী মোহাম্মদ কাসেমের উপদেশে ‘বাংলা মৌলুদ শরীফ’ রচনা করতে গিয়ে এই মহাকাব্য রচনা করেন।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পারিজাত’, এটি ১৯১২ সালে যশোর হতে মৌলভী আলতাফ হোসেন প্রকাশ করেন। এরপর ১৯১৯ সালে দ্বিতীয়, ১৯২৪ সালে তৃতীয় এবং ১৯৩৩ সালে কাব্যগ্রন্থটির চতূর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এর কবিতাগুলি কবির ছাত্রজীবনে ১৩১২ হতে মাঘ ১৩১৬ সময়ের মধ্যে লিখিত। ‘পারিজাত’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর তৎকালীন সাময়িক পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা ‘পারিজাত’কে কবিতা কাননের যথার্থ পারিজাত বলে অভিহিত করে। পারিজাত পাঠ করে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এ কাব্যগ্রন্থকে String of small poems………….verses are melodious and the rhythm admirable বলে মন্তব্য করেন।
তাঁর অন্যান্য গ্রন্থাবলীঃ
কোহিনুর কাব্য, চেতনা কাব্য, আবেহায়াত কাব্য, নিয়ামত, বাঁশরী, গুলশান ইত্যাদি। ফারসী কবি শেখ সাদীর ‘গুলিস্তা’ ও ‘বুস্তা’র কাব্যনুবাদও তিনি করেন। এছাড়া আলগীয়, কর্মবীর মুনশী মেহের উল্লাহ, ভারত সম্রাট বাবর, সুন্দর বনের ভ্রমণ কাহিনী, মালাবারে ইসলাম প্রচার, দবরুল মুখতার, আমার সাহিত্য জীবন ইত্যাদি গদ্য রচনাতেও তিনি মননশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিশোর পাঠকদের জন্য তিনি রচনা করেছেন পরীর কাহিনী, মরনের পরে, ছোটদের হযরত মুসা, হাসির গল্প ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ, শয়তানের সভা এবং শেখ সাদীর জীবনী ‘‘হায়াতে সাদী’’।
এছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থগুলি হল-আজও মনে পড়ে (গল্প গ্রন্থ), জিন্দাপীর আলমগীর(জীবনী গ্রন্থ), মজার গল্প (নৈতিক কথামূলক), গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাস (গদ্যগ্রন্থ), পরলোক প্রসঙ্গে ‘মরণের পরে’ (২য় খন্ড), শের সংহার কাব্য(কাব্যগ্রন্থ), সত্যের সন্ধান, ভাবিবার কথা, খোদাপ্রাপ্তির সোজাপথ ও দাদুর দফতর।
তাঁর উদ্যোগে ১৯১০ সালে ‘যশোর-খুলনা সিদ্দিকিয়া সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই বাঙালী মুসলমানদের প্রথম সাহিত্য সংগঠন। এই সাহিত্য সংগঠনের নিকট হতে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করে পরবর্তীকালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ ১৯১২ সালে ও ‘মুসলিম সাহিত্য সমা ‘ ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনি কলকাতার পারিজাত সাহিত্য কুটিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বি.এ. ক্লাশের ছাত্র থাকাকালে ১৯১৪ সালে তিনি ‘মাসিক মোহাম্মদীর’ সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা হতে প্রকাশিত ‘মাসিক বঙ্গনূর’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি ‘নদীয়া সাহিত্য সভা’র পক্ষ হতে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি লাভ করেন।
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিলিটারী কনভয়ের নীচে চাপা পড়ায় তাঁর পা ভেঙে যায়। ১৯৫৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমীতে ৩০ টি মুদ্রিত ও কয়েকটি অমুদ্রিত গ্রন্থ দান করেন। ১৯৬০ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন। ঐ সনেই তিনি কর্মজীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬১ সালে ছোট ভাই শেখ ফজলর রহমানের মৃত্যুতে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৬২ সালের ৭ মে ইন্তিকাল করেন। পরদিন ৮ মে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে বাংলা একাডেমীতে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালে শেখ হবিবর রহমান গ্রন্থাবলী(১ম খন্ড কাব্যগ্রন্থসমূহ) বাংলা একাডেমী হতে প্রকাশিত হয়।
Read More »

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি শতাব্দী। বিশিষ্টি ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক, বহুভাষাবিদ পন্ডিত, ধর্মবেত্তা ও সূফীসাধক। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাবিদ, গবেষক, লোকবিজ্ঞানী, অনুবাদক, পাঠসমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষাসৈনিক এবং একজন খাঁটি বাঙালি মুসলিম ও দেশপ্রেমিক। জ্ঞানপ্রদীপ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষার গবেষণায় অদ্বিতীয়।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মার পঞ্চম সন্তান। তাঁর বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন ইংরেজ আমলে সরকারি জরিপ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। শহীদুল্লাহ মাতা হরুন্নেছা খাতুনের শিক্ষার প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। তিনি বাড়িতে তাঁর পরিবার ও পেয়ারা গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের শিক্ষা দিতেন। প্রথম দিকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম রাখা হয় মুহম্মদ ইব্রাহীম। কিন্তু পরবর্তীকালে পিতার পছন্দে আকিকা করে তাঁর নাম পুনরায় রাখা হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে শহীদুল্লাহ উর্দু, ফার্সী ও আরবি শেখেন এবং গ্রামের পাঠশালায় সংস্কৃত পড়েন। পাঠশালার পড়া শেষ করে ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। স্কুলের ছাত্র থাকতেই বই পড়ার এবং নানা বিষয়ে জানার প্রতি ছিল তাঁর দারুণ নেশা। হাওড়া স্কুলের স্বনামখ্যাত ভাষাবিদ আচার্য হরিনাথ দে’র সংস্পর্শে এসে শহীদুল্লাহ ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি আরবী-ফার্সী-উর্দুর পাশাপাশি হিন্দি ও উড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্ত্বের সাথে সংস্কৃতসহ প্রবেশিকা পাশ করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে থেকে ১৯০৬ সালে এফ.এ. পাশ করেন। অসুস্থতার কারণে অধ্যায়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ. পাস করেন ১৯১০ সালে। বাঙালি মুসলমান ছেলেদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম অনার্স নিয়ে পাস করেন।
সংস্কৃতিতে অনার্স পাস করার পর সংস্কৃত নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করতে চাইলে তৎকালীন হিন্দু পণ্ডিতগণ তাঁকে পড়াতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এ বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর দু’বছর পর ১৯১৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে বি.এল. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ গমন করেন। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শণ চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্যে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা লাভ করেন।
হম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সিতাকুন্ডু উচ্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি কিছুদিন ওকালতি প্র্যাকটিস করেন। তিনি বশিরহাট মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দিনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে শরৎচন্দ্র লাহিরী রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সে বছরের ২ জুন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে স্থায়ী চাকুরিতে যোগদান করেন। একইসঙ্গে নিখরচে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সভাপতি নিযুক্ত হন। পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ১৯২৮ সালে দেশে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষকের এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষকের পূর্বপদে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি রীডার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর তিনি সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং পরে ১৯৩৭ সালে স্বতন্ত্র বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালের ৩০ জুন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে রীডার ও অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং একইসাথে উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও ছয় বছর কলা অনুষদের ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষা গড়ে তোলার জন্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি সেখানে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের অস্থায়ী প্রাধ্যক্ষের এবং ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ইমেরিটাস নিযুক্ত হন। অধ্যাপনার বাইরে তিনি করাচির উর্দু উন্নয়ন সংস্থার উর্দু অভিধান প্রকল্প, ঢাকায় বাংলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ এবং ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশনের সদস্য, ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলা একাডেমীর বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজি সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রাজে Seminar on Traditional Culture in South-East Asia -তে তিনি UNESCO -র প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এর চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি সচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, আয়ত্ত করেছিলেন বাইশটি ভাষা। তিনি বাংলা, উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী, সংস্কৃত, পালি, আসাম, উড়িয়া, আরবী, ফার্সী, হিব্রু, আবেস্তান, ল্যাটিন,তিব্বর্তী, জার্মান, ফরাসী, প্রাচীন সিংহলী, পশতু, মুন্ডা, সিন্ধী, মারহাটী, মৈথালী ইত্যাদি ভাষা জানলেও ভাষার ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সানন্দে বলতেন, আমি বাংলা ভাষাই জানি। বাংলা যে সংস্কৃত ভাষা হতে জন্ম নেয় নি, একথা প্রথম তিনিই প্রমাণ করেন। তিনিই বলেন, “বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা নহে; বরং দূর সম্পর্কের আত্মীয়া।”
তাঁর প্রকাশনা গুলি হলো:
গবেষণাগ্রন্থ: সিদ্ধা কানুপার গীত ও দোহা (১৯২৬), বাংলা সাহিত্যের কথা (১ম খণ্ড ১৯৫৩, ২য় খণ্ড ১৯৬৫), বৌদ্ধ মর্মবাদীর গান (১৯৬০)।
ভাষাতত্ত্ব: ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাংলা ব্যাকরণ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৬৫) । প্রবন্ধ-পুস্তক: ইকবাল (১৯৪৫), আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), বাংলা আদব কি তারিখ (১৯৫৭), Essay on Islam (1945), Traditional culture in East Pakistan (মুহম্মদ আবদুল হাই-এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত;১৯৬১)।
গল্পগ্রন্থ:
রকমারী(১৯৩১)।
শিশুতোষ গ্রন্থ: শেষ নবীর সন্ধানে, ছোটদের রাসূলুল্লাহ (১৯৬২), সেকেলের রূপকথা (১৯৬৫) ।
অনুবাদ গ্রন্থ: দাওয়ানে হাফিজ (১৯৩৮), অমিয়শতক (১৯৪০), রুবাইয়াত-ই-ওমর খয়্যাম (১৯৪২), শিকওয়াহ ও জাওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২), বিদ্যাপতিশতক (১৯৪৫), মহানবী (১৯৪৬), বাই অতনা মা (১৯৪৮), কুরআন প্রসঙ্গ (১৯৬২), মহররম শরীফ (১৯৬২), অমর কাব্য (১৯৬৩), ইসলাম প্রসঙ্গ (১৯৬৩), Hundred Sayings of the Holly Prophet (1945), Buddist Mystic Songs (1960)।
সংকলন: পদ্মাবতী (১৯৫০), প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে শেষ নবী (১৯৫২), গল্প সংকলন (১৯৫৩), তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। এছাড়া তিনি ৪১টি পাঠ্যবই লিখেছেন, ২০টি বই সম্পাদনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তাঁর লিখিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের উপর রয়েছে তাঁর ৩৭টি রচনা। অন্যান্য বিষয়ে বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮০টি। এ ছাড়া তিনি তিনটি ছোটগল্প এবং ২৯টি কবিতা ও লিখেছেন।
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহু মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তিনি সম্পদনা করেছেন। তিনি আল এসলাম পাত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯২৫) ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯২৮-২১) হিসেবে যোগ্যতার প্রমাণ দেন। তাঁরই সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশু পত্রিকা ‘আঙ্গুর’ (১৯২০) আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ইংরেজী মাসিক পত্রিকা ‘দি পীস’ (১৯২৩), বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘বঙ্গভূমি’ (১৯৩৭) এবং পাক্ষিক ‘তকবীর’ (১৯৪৭) সম্পাদনা করেন। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত পাক্ষিক ও মাসিক জার্নাল সম্পাদনা করেন।
এই চলন্ত বিশ্বকোষ বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ব্যক্তিটি ছিলেন পুরামাত্রায় ইসলামী শরীয়তের পাবন্দ। মুমিনের গুণাবলীগুলি তিনি তাঁর জীবনে ধারণ করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান হযরত মওলানা শাহ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.)এর খলীফা। ১৩ই জুলাই ১৯৬৯ খৃস্টাব্দে এই মহান মনীষী ৮৪ বছর বয়সে ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। মরহুমের লাশ তাঁরই নামে নামকরণকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে ঐতিহাসিক মূসা মসজিদ প্রাঙ্গনে দাফন করা হয়।
Read More »

ইসমাইল হোসেন সিরাজী

আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া,
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া,
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া,
পূত বিভূ নাম স্মরণ করি।
সিরাজগঞ্জ শহরের ছোট্ট এক কামরায় বসে লিখে চলেছেন এক তরুণ তার আপন কওমকে জাগিয়ে তোলার জন্য। লিখে চলেছেন বৃটিশ বেনিয়াদের এদেশ হতে চিরতরে উৎখাত করার জন্য। এই বেনিয়া গোষ্ঠী সমস্ত ভারত উপমহাদেশ মুসলমানদের কাছ হতে ছিনিয়ে নেয়। ক্ষোভে দুঃখে মুসলমানগণ ইংরেজদের প্রবর্তিত অনেক কিছুই ত্যাগ করে। এমনকি ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ হতেও নিজেদেরকে সরিয়ে রাখে। অপরদিকে হিন্দুরা এ সুযোগ গ্রহণ করে শিক্ষা দীক্ষায় মুসলমানদের চেয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। মুসলমানরা হয়ে পড়ে পঙ্গু কি শিক্ষা দীক্ষায়, কি সম্পদ বৈভবে। ঠিক এ সময়েই কলম তুলে নেন সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী। ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই তারিখে তিনি তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্গত সিরাজগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ আবদুল করীম এবং মাতার নাম নুরজাহান বেগম। তারা উভয়েই ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার মানুষ।
শিশু ইসমাইল হোসেনের লেখাপড়ার প্রথম সবক দেন তাঁর মা নূরজাহান খানম। নূরজাহান খানম তাঁর শিশুপুত্রকে প্রথমেই কোরআন শিক্ষা দেন। কোরআন শিক্ষা শেষ হলে তাঁকে মধ্য ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করা হয়। মেধাবী ইসমাইল হোসেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সিরাজগঞ্জের বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে এ সম্ভাবনাময় তরুণ লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আর অগ্রসর হতে পারেন নি। তাছাড়া স্বদেশের পরাধীনতা, সমগ্র মুসলিম জাহানের দুর্দশার জন্য বেদনাবোধ হতে সৃষ্টি উৎকন্ঠাও তাঁকে স্কুলের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থাকতে দেয় নি। তোমরা জানলে আশ্চর্য হবে যে, তিনি এ সময়ে নির্যাতিত অবহেলিত, লাঞ্চিত ও পদদলিত মুসলিম জাতির জন্য বেদনাবিধুর, এতই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে তুরস্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এ যাত্রায় তিনি তুরস্কে যেতে পারেন নি ঠিক কিন্তু সেই যে মুসলিম জাহানের কল্যাণের মানসে ঘর হতে বের হলেন আর কখনই সুবোধ বালকের মত ঘরে বসে থাকেন নি। অবশ্য তিনি পরবর্তীকালের তাঁর বাল্যকালের স্বপ্নের তুরস্কে গিয়েছিলেন তা অনেক পরের কথা।
ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সবচেয়ে পরিচিত কাব্যগ্রন্থ হল ‘অনল প্রবাহ’। এটি ১৮৯৯ সনে মুনসী মেহেরউল্লা প্রথম প্রকাশ করেন। পুস্তিকাটি এত জনপ্রিয় ছিল যে ১৯০০ সালে আরো কিছু কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি আবার প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯০৮ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। আর এ সময়ই ‘অনল প্রবাহ’ ও লেখক বৃটিশ রাজশক্তির আক্রমণের শিকার হন। ‘অনল প্রবাহ’ বাজেয়াপ্ত হয় এবং লেখকের দু’বছর কারাদন্ড হয়। তিনিই প্রথম কবি যার কাব্যগ্রন্থ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় এবং তিনিই বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে কারাদন্ড ভোগকারী উপমহাদেশের প্রথম সাহিত্যিক। সিরাজীর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হল ‍উচ্ছ্বাস, উৎসব, উদ্বোধন কাব্য, মহাশিক্ষা কাব্য, স্পেন বিজয় কাব্য, প্রেমাঞ্জলী(গীতিকাব্য), সঙ্গীত সঞ্জীবনী ইত্যাদি।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও মিথ্যা অপপ্রচার করতো তখন হিন্দু কবি সাহিত্যিকরা। বিশেষ করে চরম মুসলিম বিদ্বেষী ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার লেখায় সুপরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের হেয় করার চেষ্টা করতেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী এ সমস্ত কুৎসিৎ লেখার জবাব দিতে গিয়ে উপন্যাসও রচনা করেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে তারাবাই, ফিরোজা বেগম, নুরুদ্দীন, রায়নন্দিনী ও বংকিম দুহিতা। না, জবাব দিতে গিয়ে সিরাজী প্রতিআক্রমণ বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি বেছে নেননি। সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উপন্যাসে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘রায় নন্দিনী’।
সিরাজী রচিত কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী ও সঙ্গীত বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সংখ্যা ৩২টি। এগুলো হলো- কাব্যগ্রন্থ উচ্ছ্বাস (১৯০৭), নব উদ্দীপনা (১৯০৭), উদ্বোধন (১৯০৮), স্পেন বিজয় কাব্য (১৯৮৪), মহাশিক্ষা কাব্য প্রথম খন্ড (১৯৬৯), মহাশিক্ষা কাব্য দ্বিতীয় খন্ড (১৯৭১)। উপন্যাস- রায়নন্দিনী (১৯১৫), তারাবাঈ (১৯১৬), নূরউদ্দীন (১৯১৯)। প্রবন্ধ গ্রন্থ- মহানগরী কর্ডোভা (১৯০৭), স্ত্রীশিক্ষা (১৯০৭), আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪), সুচিন্তা প্রথম খন্ড (১৯১৬), তুর্কি নারী জীবন (১৯১৩), ভ্রমণ কাহিনী- তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১৩)। সঙ্গীত গ্রন্থ- সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬), প্রেমাঞ্জলী (১৯১৬) প্রভৃতি। অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- সুধাঞ্জলী, গৌরব কাহিনী, কুসুমাঞ্জলী, আবে হায়াৎ, কাব্য কুসুমোদ্যান, পুস্পাঞ্জলী। অসমাপ্ত উপন্যাস- বঙ্গ ও বিহার বিজয় এবং জাহানারা।
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ কলিকাতা ২/১ ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে, সিরাজী পাবলিক লাইব্রেরী ও ফ্রি রিডিং রুম- এর উদ্বোধন করা হয়। উক্ত দ্বারোঘাটন অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘সিরাজী সাহেব ছিলেন আমার পিতৃতুল্য। তিনি আমাকে ভাবিতেন জ্যেষ্ঠ পুত্র-তুল্য। তাঁহার নিকট যে স্নেহ আমি জীবনে পাইয়াছি তাহা আমার জীবনের পরম সঞ্চয়। ফরিদপুর কনফারেন্সে তাঁহার সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার সমগ্রজীবনই ছিল অনল প্রবাহ এবং আমার রচনায় সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গের প্রকাশ আছে। সাহিত্যিক ও রাজনীতিক ছাড়াও আমার চোখে তিনি প্রতিভাত হয়েছিলেন এক শক্তিমান দরবেশ রূপে। মৃত্যুকে তিনি ভয় করেন নাই, তুরস্কের রণক্ষেত্রে তিনি সেই মৃত্যুর সঙ্গে করিয়াছিলেন মুখোমুখি। তাই অন্তিমে মৃত্যু তাঁহার জন্য আনিয়া দিয়াছিল মহাজীবনের আস্বাদ।’
বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্ভাগ্য যে আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা মহান পুরুষ সিরাজীকে হীনমন্যতার কারণে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। দেশের মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্যসূচিতে সিরাজী রচনাবলী উপেক্ষিত। সিরাজীর লেখা থেকে বঞ্চিত এদেশের শিক্ষার্থীরা। সিরাজী সম্পর্কে তরুণ সমাজকে জানতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ সিরাজীর অনলবর্ষী  বক্তৃতায় প্রকম্পিত হয়েছিলো ব্রিটিশ সিংহাসন। তাঁর কণ্ঠ ও লেখা থেকে বারুদের গন্ধ বের হতো। তাঁর বক্তৃতায় জেগে ওঠেছিলো লাখো লাখো তরুণ। সেখানে মুসলিম বা হিন্দু বলে কোনো প্রশ্নের সৃষ্টি হয় নাই। ব্রিটিশ রাজ শুধু তাঁকে কারাবন্দীই করেনি, তার কবিতাও নিষিদ্ধ করেছিলো। সেই স্বাধীনচেতা মহাকবিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অবমূল্যায়ন করছেন। যারা মুসলমানদেরকে লাইভস্টক বা গৃহপালিত পশু বলে আখ্যায়িত করছে, যারা আমাদেরকে কাক পক্ষী, দস্যু, তস্কর, দানব, অসুর, অনার্য, ইতর, নরপশু, ডাকাত বলে গালি দিয়েছে তাদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী ঘটা করে পালন করা হয়। তাদের লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের। অথচ সিরাজীর মত মহানায়কের রচনাবলী পাঠ্য বহির্ভূতই থেকে যাচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন দুর্বিষহ অবস্থার প্রেক্ষিতে সিরাজীর মতো বিপ্লবী পুরুষের প্রসঙ্গ টেনে আনা অতীব জরুরী। ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশী জাতি সৃষ্টির এই গঠনকালে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উদারতা, দৃঢ়তা, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাতন্ত্র্যবাদ, ঐতিহ্য চেতনা, সংস্কৃতি চেতনা, বিজ্ঞান-ইতিহাস ও সাহিত্য-চেতনা প্রভৃতি থেকে প্রেরণা আহরণ একান্ত কর্তব্য। ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত সারা উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে যে জাতীয় ঐক্যবোধ, জাগরণ স্পৃহা আপন জাতীয় সত্ত্বার পরিচয় ফুটিয়ে তোলার আকাক্মখা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যে প্রতিষ্ঠা অর্জনের প্রয়াস তীব্র আবেগে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবোধের প্রেক্ষিতে সেই উদ্যম নিষ্ঠা ও কর্ম-চাঞ্চল্য একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠেছে। আবশ্যক হয়ে উঠেছে আজ আবার নতুন করে ঘনিয়ে ওঠা বিভ্রান্তির, দিশাহীনতার দিগন্তের কালো আবরণ ভেদ করে আলোকবন্যা আবাহনের জন্য নতুন করে গর্জে ওঠা হাজার হাজার সিরাজীর।’
মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই দুরারোগ্য পৃষ্ঠব্রণ রোগে আক্রান্ত হয়ে মুসলিম বিশ্বের এই মহান পুরুষ ইন্তিকাল করেন। জীবনের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বপ্রকার অনাচার, কদাচার, কুসংস্কার, অন্যায় ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সিংহের মত লড়ে গেছেন। না কোথাও কোন কারণে তিনি মাথা নত করেন নি।
Read More »

মহাকবি আল্লামা ইকবাল

‘আরব হামারা চীন হামারা হিন্দুস্তাঁ হামারা
মুসলিম হ্যায় হাম,–ওতন হ্যায়
     সারা জাঁহা হামারা।’
কোন কোন মানুষকে আল্লাহ বিশেষভাবে সৃষ্টি করেন দেশ ও জাতির খেদমতের জন্য। শত ঝড়ঝঞ্জা বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সেসব মানুষ তাঁদের কাজ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে যান। আমরা আজকে এমন এক ব্যক্তিত্ব ও কবি পুরুষ সম্বন্ধে আলোচনা করবো।
তোমরা হয়ত কোন না কোনভাবে শুনে থাকবে মহাকবি আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে। হয়ত কথাটা এজন্য বললাম যে, বর্তমানে আমাদের দেশে কবি ইকবালকে জানার তেমন সুযোগ নেই। সত্যি কথা বলতে কি এই মহান কবিকে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কবি ইকবাল পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট নামক স্থানে ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ নুর মোহাম্মদ এবং মাতার নাম ইমাম বীবী। কবির পিতা মাতা উভয়ই অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার মানুষ ছিলেন। কবির পূর্বপুরুষগণ কাশ্মীরবাসী সাপ্রু গোত্রীয় ব্রাহ্মণ পন্ডিত ছিলেন। তাঁরা সুলতান জয়নুল আবেদীন ওরফে বুদ শাহ(১৪২১-১৪৭৩ খৃ) এর রাজত্বকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দাদা শিয়ালকোটে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ষাট বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
কবির পিতা শেখ নূর মোহাম্মদ উচ্চশিক্ষিত কোন মানুষ ছিলেন না কিন্তু তিনি একজন স্বনামধন্য পন্ডিত ছিলেন। যার কারণে শামসুল উলামা সৈয়দ মীর হাসান তাঁকে(কবির পিতাকে) অশিক্ষিত দার্শনিক উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
ইকবালের জন্মের ব্যাপারে কথিত আছে যে, একদিন তাঁর পিতা স্বপ্নে দেখলেন, আকাশচারী একটি অসম্ভব সুন্দর কবুতর তার কোলে এসে পড়ল। পরে তিনি স্বপ্ন বিশারদের কাছে জানতে পারলেন অদূর ভবিষ্যতে তিনি একজন ভাগ্যবান পুত্রের বাপ হতে যাচ্ছেন। আরও কথিত আছে যে, সদ্যজাত ইকবালকে যখন পিতা নূর মোহাম্মদের কোলে দেওয়া হয় তখন তিনি সদ্যজাত শিশুপুত্রকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “বড় হয়ে দ্বীনের খেদমত করলে বেঁচে থাক, নচেৎ এখনি মরে যাও।” বুঝতে পারছ তাঁর স্নেহময় পিতা তাঁর কাছ হতে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতের জন্য কি আশা করেছিলেন?
পিতা নূর মোহাম্মদের ইচ্ছা ছিল পুত্রকে মাদরাসায় পড়ানোর কিন্তু উস্তাদ শামসুল উলামা মীর হাসানের পরামর্শে তাঁকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রাইমারী শিক্ষা শেষ হলে তাঁকে শিয়ালকোট স্কচ মিশন স্কুলে ভর্তি করা হয়। এ স্কুল হতে তিনি ১৮৯৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। স্কচ স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন তিনি একদিন দেরীতে ক্লাসে আসেন, ক্লাস টিচার তাঁর দেরিতে ক্লাসে আসার কারণ জানতে চাইলে বালক ইকবাল তৎক্ষণাত উত্তর দেন, “ইকবাল(সৌভাগ্য) দেরিতে আসে স্যার।” উত্তর শুনে পন্ডিত শিক্ষক তো ‘থ’। তিনি যে শুধু উপস্থিত বুদ্ধিতে দক্ষ ছিলেন তা নয়। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। ১৮৮৮, ১৮৯১ ও ১৮৯৩ সালে যথাক্রমে প্রাথমিক বৃত্তি, নিম্ন মাধ্যমিক বৃত্তি ও প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি স্বর্ণপদক ও মাসিক বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৯৩ সালে স্কচ মিশন স্কুল কলেজে উন্নীত হলে ইকবাল এখানে এফ. এ. শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৯৫ সালে অনুষ্ঠিত এফ.এ. পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং যথারীতি বৃত্তিসহ স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৮৯৫ সালে তিনি শিয়ালকোট হতে লাহোরে এসে লাহোর সরকারী কলেজে বি.এ ভর্তি হন। এখানে একটা খবর দিয়ে রাখি, ইকবাল যখন বি.এ পড়ার জন্য পিতার নিকট অনুমতি চাইলেন তখন তাঁর পিতা তাঁকে বলেছিলেন, ‘ছাত্র জীবন শেষ করার পর অবশিষ্ট জীবন ইসলামের খিদমতে ওয়াকফ করে দিতে হবে।’
হ্যাঁ, তিনি তাতেই রাজী হয়েছিলেন। আর সত্যি সত্যিই তাঁর সারাটা জীবন ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। লাহোর সরকারী কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি টি.ডব্লউ এর মত ভূবন বিখ্যাত একজন সুযোগ্য শিক্ষক পান যিনি ছিলেন আরবী ভাষায় সুপন্ডিত, দর্শনের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক। প্রতিভাবান ইকবালকে ছাত্র হিসেবে পেয়ে আরনল্ড সাহেব তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন এবং মনের মত করে গড়ে তুলেছিলেন। ১৮৯৭ সালে তিনি আরবী ও ইংরেজিতে সমগ্র পাঞ্জাবে প্রথম স্থান নিয়ে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যে কারণে তিনি এবার দুটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এরপর ১৮৯৯ সালে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাস করেন। সাথে সাথে তিনি লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে ইতিহাস ও দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এর সামান্য কিছুকাল পরই তিনি লাহোর সরকারী কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজের ইংরেজি ও দর্শনশাস্ত্রের খন্ডকালীন সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এ সময়ে উর্দু ভাষায় অর্থশাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁর সর্বপ্রথম পুস্তক রচনা করেন। তাঁর জীবন ছিল ছকে বাঁধা। এ সম্বন্ধে ইসলামী বিশ্বকোষ লিখেছে, “তিনি ভোরে ওঠে ফজরের সালাত আদায় করতেন, অতঃপর উচ্চস্বরে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। তারপর কিছুক্ষণ শরীরচর্চা করতেন এবং কিছু না খেয়ে কলেজে যেতেন। দুপুরে বাড়ি ফিরে আহার করতেন। অনেক সময় গভীর রাতে ওঠে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। একবার তিনি একাধারে দুই মাস এই রাত্রিকালীন সালাত আদায় করেন।’
১৯০৫ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মানসে লন্ডন গমন করেন। পথিমধ্যে তিনি খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, সূফী কবি আমীর খসরু ও মহাকবি গালিবের মাযার জিয়ারত করেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি দর্শনশাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। এ সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পান বিশ্ব খ্যাত দার্শনিক ডঃ এম সি ট্যাগার্টকে। এরপর তিনি পশ্চিম ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। শেষে জার্মানীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারস্যের দর্শন শাস্ত্র বিষয়ক সন্দর্ভ লিখে ১৯০৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। এরপরের বছর লিংকন ইন হতে ব্যারিস্টারী পাস করেন। এ সময় তাঁর প্রিয় শিক্ষক স্যার আর্নল্ড লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবীর অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বিশেষ কারণে কয়েক মাসের ছুটিতে গেলে ইকবাল ৬ মাসের জন্য তাঁর স্থানে আরবীর অস্থায়ী অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
১৯০৮ সালের ২৭ শে জুলাই তিনি দেশে ফিরে এলে লাহোরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করেন। তিনি লাহোরে ফিরে স্বপদে পুনর্বহাল হন এবং সরকারের অনুমতিক্রমে আইনব্যবসা শুরু করেন। অবশ্য দেড় বছর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে তিনি আইনব্যবসা শুরু করেন। তবে একটা কথা জেনে রাখা দরকার, তিনি কখনই মাসিক খরচের পরিমাণ টাকা রোজগারের পর কোনও মোকদ্দমা গ্রহণ করতেন না। আরও একটা কথা, তিনি যদি বুঝতেন কোন মোকদ্দমায় মক্কেলের তেমন কোন উপকার করতে পারবেন না তা’হলেও তিনি সে কেস গ্রহণ করতেন না। শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি এভাবে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ সালে শিয়ালকোটের এক কবিতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর কবি প্রতিভার বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। এরপর তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখে হায়দারাবাদের প্রখ্যাত কবি দাগের নিকট পাঠিয়ে দেন সংশোধনের জন্য। কবি দাগ কিশোর কবির এ কবিতাগুলি পেয়ে মনোযোগ সহকারে পড়েন ও চমৎকার একটি মন্তব্য লিখে পাঠান। কবি দাগ লিখেছিলেন, ‘এ কবিতাগুলি সংশোধন করার কোন দরকার নেই। এগুলো কবির স্বচ্ছ মনের সার্থক, সুন্দর ও অনবদ্য ভাব প্রকাশের পরিচয় দিচ্ছে।’ কবি ইকবাল এ চিঠি পেয়ে তো খুব উৎসাহ পেলেন। তাঁরপর হতে চললো তাঁর বিরামহীন কাব্যসাধনা। এরপর ১৯০০ সালে তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত আঞ্জুমানে হিমায়েতে ইসলাম-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় জীবনের প্রথম জনসমক্ষে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নালা ইয়াতীম’ বা অনাথের আর্তনাদ পাঠ করেন। কবিতাটি পড়ার পর চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। মানে কবিতাটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, তাৎক্ষণিকভাবে কবিতাটি ছাপা হয় এবং এর প্রতিটি কপি সে সময় চার টাকা দামে বিক্রি হয়। বিক্রয়লব্ধ প্রচুর পরিমাণ টাকা ইয়াতিমদের সাহায্যার্থে চাঁদা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯০১ সালে তিনি ছোটদের জন্য লেখেন-মাকড়সা ও মাছি, পর্বত ও কাঠবিড়ালি, শিশুর প্রার্থনা, সহানুভূতি, পাখীর নালিশ, মায়ের স্বপ্ন প্রভৃতি কবিতা।
এরপর তিনি দু’হাতে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ছিল, ‘স্বদেশপ্রেম, মুসলিম উম্মাহর প্রতি মমত্ববোধ, ইসলামের শ্বাশত আদর্শে তাওহীদভিত্তিক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, জাতির উত্থান-পতন, দলীয় কলহ ও অন্তর্দ্বন্ধ নিরসন প্রভৃতি বিষয় কবিতায় স্থান পেতো। ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে তিনি বেলালী সুরে আহবান জানাতেন ক্লান্তিহীনভাবে। স্বকীয় আদর্শের সন্ধানে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে তোলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল।’
তাঁর কাব্যে এ ধরনের চিরন্তন আবেদন থাকার কারণে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হন। নানামুখি প্রতিভার অধিকারী এ মহান ব্যক্তিত্ব তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সর্বমহল হতে অকুন্ঠ সম্মান অর্জন করেন। মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন হিন্দু অধ্যাপক বলেছিলেন, “মুসলমানগণ ইকবালকে লক্ষবার তাঁদের সম্পদ বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু তিনি কোন ধর্ম বা শ্রেণীবিশেষের সম্পদ নন-তিনি একান্তভাবে আমাদেরও।’’
১৯০১ সালে ‘হিমালাহ’ নামক কবিতাটি তৎকালীন সময়ের উর্দু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘মাখযানে’ ছাপা হয়। এটিই পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম কবিতা। মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে তিনি এসময় অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। ১৯০৩ সালে লাহোর হতে অর্থনীতির ওপর তাঁর প্রথম পুস্তক ‘আল  ইলমুল ইকতেসাদ’ প্রকাশিত হয়।
১৯২৪ সালে ‘বাঙ্গেদারা’ বা ঘন্টাধ্বনি নামক তাঁর বিখ্যাত কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত এ গ্রন্থটির বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদী’ বা ব্যক্তিত্বের গূঢ় রহস্য। এ কাব্যগ্রন্থটি ১৯২০ সালে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন ডঃ আর.এ.নিকোলসন। সাথে সাথে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে মহাকবি ও বিশ্বকবি আল্লামা ইকবালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালে ‘আসরার-ই-খুদী’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। বিশ্বের বহু ভাষায় এ কাব্যগ্রন্থটি অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
১৯১১ ও ১৯১২ সালে পঠিত তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কবিতা ‘শিকওয়াহ’ বা অভিযোগ ও ‘জওয়াব-ই-শিকওয়াহ’ বা অভিযোগের জবাব উর্দু ভাষায় রচিত। এ দীর্ঘ দুটি কবিতার কাব্যগ্রন্থ দু’টির বাংলা ভাষায় একাধিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় রচিত ‘পায়াম-ই-মাশরিক’ প্রাচ্যের বাণী কাব্যগ্রন্থটি। গ্রন্থটি আরবী, ইংরেজী, তুর্কী, জার্মান ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় ‘রামূয-ই-বেখুদী’ বা আত্মবিলোপের গুঢ়তত্ত্ব কাব্যগ্রন্থটি। মূলত এ গ্রন্থটি ‘আসরারে খুদী’র দ্বিতীয়াংশ। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ গ্রন্থটির ৮৪ তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘বালে জিবরীল’ বা জিবরাঈলের ডানা উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘দরবারে কালীম’ বা মূসার লাঠির আঘাত কাব্যগ্রন্থটি। উর্দু ভাষায় রচিত এ কাব্যগ্রন্থটি আরবী ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েও প্রকাশিত হয়।
এর আগে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘যাবুরে আজম’ বা প্রাচ্যের ধর্ম সংগীত কাব্যগ্রন্থটি। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় রচিত ‘জাবীদ নামা’ বা অমর লিপি কাব্যগ্রন্থটি। এমনিভাবে একের পর এক তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত তিনি প্রাচ্যের সেই ভাগ্যবান কবি ব্যক্তিত্ব যার রচনা এত ব্যাপকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সত্যিই যদি বিশ্বকবি বিশেষণে কাউকে বিশেষিত করতেই হয় তবে সে সম্মানের অধিকারী নিঃসন্দেহে কবি আল্লামা ইকবাল। কবি নিজেও ছিলেন বহু ভাষাবিদ পন্ডিত। তিনি উর্দু, ফারসী, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় লেখনি চালিয়েছেন।
কবি The Development of Metaphysics in Iran বা ‘প্রজ্ঞান চর্চায় ইরান’ এই বিষয়ের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯০৮ সালে লন্ডন হতে এ থিসিস প্রকাশিত হয়।
এতক্ষণ তাঁকে কবি হিসেবে পরিচয় দিলাম। আসলে তিনি শুধুই কবি ছিলেন না। তিনি সমাজসেবী, রাজনীতিবিদ, প্রখ্যাত দার্শনিক আইনজ্ঞ প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি পাঞ্জাব আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩০ সালে নির্বাচিত হন মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে। ১৯৩১ ও ১৯৩২ সালে তিনি বিলেত গমন করেন ‘গোল টেবিল’ বৈঠকে যোগদানের জন্য। এই বৈঠকে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন দাবি দাওয়া পেশ করেন। অবশ্য এর আগে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে ১৯৩০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাই যে-পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান একটি রাষ্ট্রে পরিণত হউক। পৃথিবীর এই অংশে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে হোক বা বাইরে হউক-অন্ততপক্ষে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে একটি মুসলিম রাষ্ট্র সংগঠনই আমার মতে মুসলমানদের শেষ নিয়তি।’ এই মত অনুযায়ীই পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এ জন্য তাঁকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার বলা হয়। অবশ্য তিনি ১৯৩৭ সালের ২১শে জুন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি যেভাবে প্রস্তাব করছি সেভাবে পুনর্গঠিত মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের একটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্রই হল একমাত্র উপায়, যদ্বারা একটি শান্তিপূর্ণ ভারত গড়ে উঠতে পারে এবং সাথে সাথে অমুসলিম আধিপত্য থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে রক্ষা করা যেতে পারে। উত্তর পশ্চিম ভারত এবং বাংলার মুসলমানদেরকে কেন একটি স্বতন্ত্র জাতিরূপে স্বীকৃতি দেয়া হবে না-যাতে তারা ভারতের এবং ভারতের বাইরের অন্যান্য জাতিসমূহের ন্যায় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পেতে পারে?’ এ উদ্ধৃতিতে তিনি যে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্যও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলেছিলেন তা নিশ্চয় বুঝা যায়। মূলত আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ত্বও তাঁরই চিন্তার ফসল। অথচ এ মহান ব্যক্তিত্ত্বকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর হতে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হচ্ছে, একথা আগেই বলেছি। তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে যে কারণে তিনি নাকি পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। অথচ তিনি পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ারও বেশ আগে ১৯৩৮ সালের ২১শে এপৃল ইন্তিকাল করেন। আশা করি বুঝতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না যে, আমরা এ মহান ব্যক্তিত্ত্বকে অস্বীকার করে কি পরিমাণ মূর্খতায় ও ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। সত্যি কথা আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু অনুদার বুদ্ধিজীবি এর জন্য দায়ী।
উপমহাদেশের এ প্রখ্যাত দার্শনিক কবি অসম্ভব দেশপ্রেমিক একজন মানুষ ছিলেন। লেখার শুরুতেই যে কবিতাটির উদ্ধৃতি দিয়েছি তার কাব্যানুবাদ এ রকমের-
‘আরব আমার, ভারত আমার, চীনও আমার-
নহে তো পর-
মুসলিম আমি,- জাহান জুড়িয়া
ছড়ানো রয়েছে আমার ঘর।’
দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সচেতনভাবে এ কবিকে বর্জন করা হয়। তার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে জহুরুল হক নামকরণ করা, পাঠ্যতালিকা হতে তাঁর রচনা ও জীবনী বাদ দেয়া।
আমরা আশা করবো এখন হতে নতুন করে আবার আমরা ইকবাল চর্চায় ফিরে যাব। কবিকে তাঁর প্রকৃত সম্মানে সম্মানিত করবো। দেশের সব শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে তাঁর রচনা অন্তুর্ভুক্ত হওয়া এ জাতির কল্যাণের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন, সে দিকটা দেখার জন্য সরকারের প্রতি আহবান রইলো।
Read More »