Tuesday, October 20, 2015

শেখ হবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতি চিন্তা ও চর্চার একটা গঠনমূলক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। মীর মোশাররফ হোসেন(১৮৪৭-১৯৯১), মোজাম্মেল হক(১৮৫০-১৯৬১), কায়কোবাদ(১৮৫৮-১৯৫১) যে ধারার সূচনা করেছিলেন পরবর্তীতে মুনসী মুহম্মদ মেহেরউল্লা (১৮৬১-১৯০৭), ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৭৯-১৯৩১), শেখ ফজলুল করীম (১৮৮২-১৯৩০), শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন (১৮৯১-১৯৬২) প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক, সংগ্রামীগণ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে এগিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের তুলনায় অনগ্রসর মুসলমানদের স্বরূপ সন্ধান, স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ ও তাদের জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করতে। এ ক্ষেত্রে তারা সব দিক হতে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মুসলিম জাতীয় জাগরণের পথিকৃত মুনসী মেহেরউল্লার নিকট হতে। মুনসী মেহেরউল্লা বুঝতে পেরেছিলেন পরাধীন দেশে বৈরী শাসনাধীনে মুসলমান সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজন তাদের মধ্যে নবজাগরণের। আর এ নব জাগরণ সম্ভব করার জন্য তিনি নিজে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, বক্তৃতা, বিবৃতি, লেখালেখির সাথে সাথে গড়ে তুলেছিলেন একটি সাহিত্যিক সম্প্রদায়।
“শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ছিলেন সেই সাহিত্যিক সম্প্রদায়েরই একজন। তাঁর জীবন সাধনার আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল বাঙালী মুসলমানের জন্য সম্মানজনক ও শ্রদ্ধাশীল আত্মপরিচয় নির্মাণে সহায়তা করা। ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্য ভিত্তিক নবজাগরণমূলক কাব্য রচনা, ভারতবর্ষের মুসলমানদের গৌরবময় অতীত ও প্রেরণাদায়ক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা, ধর্মীয় চেতনা ও মননশীলতা বিকাশে ‘সহায়ক সমৃদ্ধশালী বিদেশী সারাবান সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ ও দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের চরিত-মানস গঠন উপযোগী শিশুতোষ সাহিত্য রচনার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে একটি নব চেতনা জাগৃতির প্রত্যাশী ছিলেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী কালব্যাপী শিক্ষকতা জীবনের পাশাপাশি তাঁর সৃজনশীল সাহিত্য সাধনার মধ্যে সংকীর্ণতা রহিত মুক্তবুদ্ধি সঞ্জাত সম্প্রদায়গত সমৃদ্ধি কামনা ও সমাজ হিতৈষণার পরিচয় পাওয়া যায়।”(শেখ হবিবর রহমান-মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, পৃ.৯)।
শেখ হবিবর রহমান নিজের সাহিত্য সাধনা সম্বন্ধে ‘আমার সাহিত্য জীবন’ গ্রন্থের ১০৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
“আমার সাহিত্য বরাবর মোল্লা ধরনের; এইজন্য ইহা অনেকের নিকট উপেক্ষিত। নিয়ামত, আবেহায়াত ইত্যাদি ধরনের পুস্তকের নাম বোধ হয় মুসলমান সমাজে সর্বপ্রথম আমিই রাখিয়াছি। এতদ্ব্যতীত আমার বিবিধ পুস্তকে আরবী, ফারসী শব্দের ব্যবহার এত অধিক যে, আমাদের মধ্যে আর কেহই তত অধিক শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন কিনা সন্দেহ। জাতীয়ভাবে জাতীয় শব্দের সংমিশ্রণে জাতীয় সাহিত্যের সৃষ্টি আমার জীবনের প্রধান একটি সাধনা।”
শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ১৮৯০ মতান্তরে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তদানিন্তন যশোর জেলার বর্তমান মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলাধীন ঘোষগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ দেরাজতুল্লাহ এবং দাদার নাম শেখ হেরাজতুল্লাহ। জানা যায় আরব দেশ হতে তাঁর পূর্ব পুরুষ এদেশে এসেছিলেন এবং ঘোষগাতি গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
শেখ হবিবর রহমানরা দুই ভাই ছিলেন। তাঁর ছোটভাই শেখ ফজলর রহমানও একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা ও ধর্ম প্রচার করে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে ‘পুলুম আঞ্জুমানে হেমায়তুল ইসলাম’ নামক ধর্মীয় সামাজিক সংগঠনের সম্পাদক ও ‘আলমগীর লাইব্রেরীর পক্ষে বড় ভাই শেখ হবিবর রহমানের বেশ কয়েকখানি পুস্তক প্রকাশ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
শেখ হবিবর রহমানের লেখাপড়া গ্রামের পাঠশালায় শুরু হয়। পরে পুলুম প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে উচ্চ প্রাথমিক পাঠ শেষ করে তিনি ফুলতলা ইউনিয়ন হাইস্কুলে ভর্তি হন। আরও পরে ১৯০৭ সালে সেখান হতে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে ১৯১০ সালে যশোর জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশের আগেই ১৯০৯ সালে তাঁর স্নেহময়ী পিতা ইন্তিকাল করেন। এজন্য তাঁর শিক্ষাজীবন দারুণ অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। পিতৃবিয়োগের পর তাঁকে বহু কষ্টে তাঁর যাবতীয় খরচ নির্বাহ করতে হত। ১৯১৪ সালে তিনি বি.এ. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এখানেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বি.এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি যশোর জেলা স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আরও পরে ১৯২২ সালে কলকাতা ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে এল.টি. ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালে এল.টি. পাশ করেন।
ঐ বছরই তিনি বারাসাত গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। নয় মাস পরে তাঁকে মক্তব সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে খুলনায় বদলী করা হয়।
শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্নকে ১৯২৭ সালে খুলনা হতে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলে বদলী করা হয় এবং সেখানে ৪ বছর চাকুরী করার পরে ১৯৩০ সালে পুনরায় তাকে বারাকপুর সরকারী হাইস্কুলে বদলী করা হয়। এই স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৪ সালে তিনি চাকরী হতে অবসর গ্রহণ করেন।
খুলনা শহরে অবস্থানকালে তিনি পুনরায় ১৯৫১ সালে করোনেশন বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পদে যোগদান করেন এবং কর্মজীবন হতে দ্বিতীয়বারের মত ১৯৬০ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায়ই তাঁর মধ্যে সৃজনশীল রচনার প্রেরণা দেখা যায়। এই সময়ে তিনি ‘গো-জাতির প্রতি অত্যাচার’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। পয়গ্রাম কসবা মাইনর স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় মুনসী মুহম্মদ মেহেরউল্লা এক ধর্মসভায় গেলে সেখানে তিনি দুটি কবিতা পাঠ করেন। কবিতা দু’টি শুনে মুনসী মেহেরউল্লা তাঁকে ‘শিশুকবি’ খেতাবে ভূষিত করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘পেচক পন্ডিত’ নামের একটি কবিতা। কবিতাটি ১৩১৪ সনের ১৫ আশ্বিন ‘মোসলেম সুহৃদ’ এবং ১৮ আশ্বিন ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় ছাপা হয়।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯০৬ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘কোহিনুর কাব্য’। ফুলতলা(খুলনা) জুনিয়র মাদ্রাসার সেক্রেটারী মৌলভী মোহাম্মদ কাসেমের উপদেশে ‘বাংলা মৌলুদ শরীফ’ রচনা করতে গিয়ে এই মহাকাব্য রচনা করেন।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পারিজাত’, এটি ১৯১২ সালে যশোর হতে মৌলভী আলতাফ হোসেন প্রকাশ করেন। এরপর ১৯১৯ সালে দ্বিতীয়, ১৯২৪ সালে তৃতীয় এবং ১৯৩৩ সালে কাব্যগ্রন্থটির চতূর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এর কবিতাগুলি কবির ছাত্রজীবনে ১৩১২ হতে মাঘ ১৩১৬ সময়ের মধ্যে লিখিত। ‘পারিজাত’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর তৎকালীন সাময়িক পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা ‘পারিজাত’কে কবিতা কাননের যথার্থ পারিজাত বলে অভিহিত করে। পারিজাত পাঠ করে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এ কাব্যগ্রন্থকে String of small poems………….verses are melodious and the rhythm admirable বলে মন্তব্য করেন।
তাঁর অন্যান্য গ্রন্থাবলীঃ
কোহিনুর কাব্য, চেতনা কাব্য, আবেহায়াত কাব্য, নিয়ামত, বাঁশরী, গুলশান ইত্যাদি। ফারসী কবি শেখ সাদীর ‘গুলিস্তা’ ও ‘বুস্তা’র কাব্যনুবাদও তিনি করেন। এছাড়া আলগীয়, কর্মবীর মুনশী মেহের উল্লাহ, ভারত সম্রাট বাবর, সুন্দর বনের ভ্রমণ কাহিনী, মালাবারে ইসলাম প্রচার, দবরুল মুখতার, আমার সাহিত্য জীবন ইত্যাদি গদ্য রচনাতেও তিনি মননশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিশোর পাঠকদের জন্য তিনি রচনা করেছেন পরীর কাহিনী, মরনের পরে, ছোটদের হযরত মুসা, হাসির গল্প ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ, শয়তানের সভা এবং শেখ সাদীর জীবনী ‘‘হায়াতে সাদী’’।
এছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থগুলি হল-আজও মনে পড়ে (গল্প গ্রন্থ), জিন্দাপীর আলমগীর(জীবনী গ্রন্থ), মজার গল্প (নৈতিক কথামূলক), গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাস (গদ্যগ্রন্থ), পরলোক প্রসঙ্গে ‘মরণের পরে’ (২য় খন্ড), শের সংহার কাব্য(কাব্যগ্রন্থ), সত্যের সন্ধান, ভাবিবার কথা, খোদাপ্রাপ্তির সোজাপথ ও দাদুর দফতর।
তাঁর উদ্যোগে ১৯১০ সালে ‘যশোর-খুলনা সিদ্দিকিয়া সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই বাঙালী মুসলমানদের প্রথম সাহিত্য সংগঠন। এই সাহিত্য সংগঠনের নিকট হতে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করে পরবর্তীকালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ ১৯১২ সালে ও ‘মুসলিম সাহিত্য সমা ‘ ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনি কলকাতার পারিজাত সাহিত্য কুটিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বি.এ. ক্লাশের ছাত্র থাকাকালে ১৯১৪ সালে তিনি ‘মাসিক মোহাম্মদীর’ সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা হতে প্রকাশিত ‘মাসিক বঙ্গনূর’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি ‘নদীয়া সাহিত্য সভা’র পক্ষ হতে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি লাভ করেন।
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিলিটারী কনভয়ের নীচে চাপা পড়ায় তাঁর পা ভেঙে যায়। ১৯৫৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমীতে ৩০ টি মুদ্রিত ও কয়েকটি অমুদ্রিত গ্রন্থ দান করেন। ১৯৬০ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন। ঐ সনেই তিনি কর্মজীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬১ সালে ছোট ভাই শেখ ফজলর রহমানের মৃত্যুতে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৬২ সালের ৭ মে ইন্তিকাল করেন। পরদিন ৮ মে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে বাংলা একাডেমীতে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালে শেখ হবিবর রহমান গ্রন্থাবলী(১ম খন্ড কাব্যগ্রন্থসমূহ) বাংলা একাডেমী হতে প্রকাশিত হয়।

No comments:

Post a Comment