Tuesday, October 20, 2015

গোলাম মোস্তফা

কবি গোলাম মোস্তফা বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষক। তিনি বৃহত্তর যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমান জেলা) শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে ১৮৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কাজী গোলাম রব্বানী। মাতার মোসাম্মাৎ শরীফা খাতুন। তাঁর দাদা কাজী গোলাম সারওয়ার। গোলাম মোস্তফার পূর্বপুরুষ ছিলেন মুগল যুগে বিচার বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা। তাদের উপাধি ছিল কাজী। সেই সূত্রে গোলাম মোস্তফার পিতা, পিতামহ কাজী উপাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু গোলাম মোস্তফা নিজে কোন অর্জিত সম্মান বা প্রচলিত কৌলিণ্য প্রথার যৌক্তিকতা খুঁজে না পাওয়ায় কাজী উপাধি গ্রহণ করেননি। বহুকাল পূর্ব থেকেই মনোহর পুরের কাজী পরিবার ছিল আরবি, ফারসি ও বাংলা ভাষাতে সুপণ্ডিত। কবি গোলাম মোস্তফার জন্মসাল নিয়ে একটু কথা আছে। তিনি নিজেই “আমার জীবন স্মৃতি” তে লিখেছেন: ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে আমার জন্ম। কিন্তু আমার মনে আছে শৈলকুপা হাইস্কুলে ভর্তি হবার সময় আমার আব্বা আমার বয়স প্রায় দুই বছর কমিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই প্রকৃত জন্ম হয়েছিলো সম্ভবত ১৮৯৫ খৃস্টাব্দে। তবে এটা ঠিক যে, বাংলা তারিখ ছিলো ১৩০৪ সালের ৭ ই পৌষ রবিবার।কবির স্মৃতিকথা থেকেই আমরা কবির সঠিক জন্ম সন, বাংলা মাসের হিসেব এবং দিনের নাম রবিবার পাই। কিন্তু ইংরেজি মাসের হিসেবটা উহ্য থেকে যায়। তাঁর সঠিক জন্ম তারিখটা পরিবার থেকে সংরক্ষণ করা হয়নি। কবির পিতার দুই স্ত্রীর মধ্যে প্রথম স্ত্রীর গর্ভে বড়– নামে এক কন্যা এবং কাজী গোলাম মোস্তফা ও কাজী গোলাম কাওসার নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তিনটি সন্তান তাঁরা যথাক্রমে কাজী গোলাম কুদ্দুস, মাজু এবং খুকি। কাজী গোলাম মোস্তফাই আমাদের প্রিয় কবি গোলাম মোস্তফা। এই পরিবারের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার নিবেকৃষ্ণ পুর গ্রামে। কবির মাতা ছিলেন একজন স্বভাব কবি। স্বভাব কবিত্ব ব্যক্তি মায়ের সাথে থেকে কবির মধ্যেও কবিত্ব ভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের আশা আকাঙ্খা ও স্বপ্নের পথিকৃত শিশুদের নিয়ে এমন শাশ্বত ও চিরন্তন বাণী সিঞ্জিত লেখা যার কলমের ডগায় বেরিয়ে আসে, তিনিই ইসলামী রেনেসাঁর এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ স্বর কবি গোলাম মোস্তফা।
কৈশোর ও বাল্য জীবন
কবির বাল্য জীবন নিজ গ্রাম মনোহর পুরেই কেটেছে। কুমার নদী বিধৌত মনোহরপুর গ্রামের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, সরল আতিথিয়তা বাৎসল্য গায়ে মেখেই কবি বেড়ে উঠে ছিলেন।তাঁর জন্মস্থান মুখরিত ছিল যমুনা, কুমার মধুমতি, চিত্রা, ভৈরব, ভদ্রা চন্দনা, নবগঙ্গা, হানু বারাসিয়া, মাথাভাঙ্গা আর কপোতাক্ষ প্রভৃতি সেকালের খরস্রোত নদীর কলতানে। বাংলাদেশে বোধকরি আর কোন জেলায় এত নদীর রূপালী ধারার মিলন ঘটেনি। এসব বহমান নদীর তীরে নারকেলÑখেজুর কুঞ্জ ঘেরা শ্যামল প্রকৃতি যে কোন ভাবুক মানুষের মনে সঞ্চার করে কাব্যকলার মাধুরি। এ গ্রামীন পাগলকরা সৌন্দর্যই শিশু গোলাম মোস্তফাকে ভাবুক করে গড়ে তোলে ও কবি হতে সাহায্য করে। কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
শারদ প্রভাত চাদিনীর রাত সুপ্তি নীরব ধরা
আতট পূরতি সরসী সলিল পদ্ম পানায় ভরা।
কলমী লতিকা ডাঁটায় ও পাতায় ছাইয়া ফেলেছে জল
মাঝে মাঝে তার নানান রঙের ফুটেছে পুষ্পদল।
এই কবিতায় কবি তাঁর চারপাশের নদী প্রকৃতির এক অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে কাব্যরস পিপাসুকে উপহার দিয়েছেন নিটোল ছন্দ সৌকর্ষ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময়তা। কবিতার মতই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মোহনীয় রূপ গায়ে মেখেই কবির শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো অতিবাহিত হয়। গ্রামের স্নিগ্ধ শ্যামল সৌন্দর্যই তাঁর প্রাণে প্রথম কবিত্বভাব জাগিয়েছিলো। বস্তুত এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশই ছিল A meet nurse for a Poetic Child তাইতো পরিণত বয়সে তিনি লিখতে পেরেছিলেন:
নিখিলের এত শোভা, এত রূপ, এত হাসি গান
ছাড়িয়া মরিতে মোর কভু নাহি চাহে মন প্রাণ।
এ বিশ্বের সবই আমি বাসিয়াছি ভালো
আকাশ বাতাস জল রবি শশী তারকার আলো।
প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজ সরল মাটির গন্ধে বেড়ে উঠার কারণেই সারা জীবন কবির মধ্যে সরলতাবোধ, সম্প্রীতিবোধ, আতিথিয়তাবোধ, মানবতাবোধ তার ব্যক্তিত্বের সাথে মিশে ছিলো। কবি হতে পেরেছিল উদার ও সরলতার প্রতিক এক মানসভূমি। কিন্তু কবির বেড়ে ওঠার জীবনটা মোটেই স্বচ্ছন্দ ছিলো না। অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তাকে সাফল্যের মুখ দেখতে হয়েছিল। কবি কন্যা ফিরোজা খাতুন লিখেছেন: আমার আব্বা কবি গোলাম মোস্তফার হাতের লেখার মত তাঁর ভাষাও অতি সুন্দর ও মিষ্টি স্বচ্ছন্দ গতি একটুও বাধে না কোথাও। কিন্তু তাঁর জীবন অত সহজ ও স্বচ্ছন্দ ছিল না। তাঁর জ্ঞান পিপাসিত প্রতিভার তরীকে উজান পথে অনেক ঝড় ঝাপটার মুকাবিলা করে বেয়ে নিতে হয়েছে লক্ষ্যস্থলে। শৈশব কালেই সৎমা থাকায় স্বভাবতই বাপের অবহেলায় কখনও মামার বাড়ি কখনও নিজের বাড়ি থাকতে হতো। আর্থিক অনটনে শৈশবেই টিউশনি করতে হতো, তারপরও ক্লাসে ফাষ্ট হয়েছেন। তার জীবনকে সংগ্রামের মধ্যে পরিচালিত করার মাধ্যমে শৈশবের সে সংগ্রাম তিনি কাটিয়ে উঠে ছিলেন। জীবনকে সাজিয়েছিলেন বর্ণাঢ্যতায়। নিজ যোগ্যতা ও মেধার কারিশমায় চলমান জীবনকে করেছিলেন উচ্চকিত দ্যুতিময়।
শিক্ষা জীবন ও মানস গঠন
শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগের কারণেই মাত্র চার বছর বয়সেই পিতা মুন্সি গোলাম রব্বানীর কাছে কবির লেখা পড়ার হাতে খড়ি হয়েছিল। মনোহরপুরের পাশ্ববর্তী দামুদিয়া গ্রামের পাঠ শালাতে প্রথমে শিশু গোলাম মোস্তফাকে ভর্তি করা হয়। এখানে কিছুদিন লেখাপড়ার পর কবিকে নিকটবর্তী ফাজিলপুর গ্রামের পাঠ শালাতে ভর্তি করা হয়।
ফাজিলপুর পাঠ শালায় দুই বছর লেখাপড়া করবার পর তাঁকে ভর্তি করা হয় শৈলকুপা হাই স্কুলের নীচের শ্রেণীতে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করে পুরস্কৃত হন।
শৈলকুপা স্কুল থেকেই তিনি ১৪১৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খুলনার দৌলতপুর কলেজ হতে ১৯১৬ সালে আই. এ. পাশ করেন। এরপর গোলাম মোস্তফা উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তদানীন্তন বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কোলকাতা গমন করেন। ১৯১৮ সালে তিনি কোলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন। ঐ কলেজ থেকে ঐ বছর যশোরের কৃতি সন্তান মোহাম্মদ গোলাম হোসেন (১৮৭৩Ñ১৯৬৪ খৃ.) বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসেবে বি.এ. পাশ করেন। লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (১৮৯৪Ñ১৯৫০ খৃ.)ও রিপন কলেজে পড়াকালীন সময়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন।
আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাঁর আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করার পর ১৯২২ সালে গোলাম মোস্তফা ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. টি. পাশ করেন। এরপর আর কোন একাডেমিক ডিগ্রী অর্জন না করলেও সারা জীবন শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষা অর্জনের পেছনেই ব্যয় করেছেন।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে যে সময়ের বৃত্তে কবি গোলাম মোস্তফার জন্ম হয়, সেই সময়টা বাঙালী মুসলমানদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়Ñকারণ এই পর্বে অন্তত: তিনটি ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগতির মাত্রা ছিল অত্যন্ত দ্রুত। এগুলো হল: শিক্ষা, রাজনীতি এবং আর্থিক। অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের কোন প্রভাব ছিল না।বিশ ও ত্রিশ দশকে কৃষক প্রজাপার্টির অভ্যূদয় (১৯১৯ খৃ.), বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে মুসলমান নেতাদের বিজয় (১৯৩৭ খৃ.) এসবই বাঙালী মুসলমানদের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। মুসলমানদের মধ্যে এর আগে যাঁরা নেতৃত্ব পদে ছিলেন তাঁরা প্রধানত অবাঙালী। বাঙালী সংস্কৃতি ও ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে সমন্বয়ের সুযোগ ছিলো, বরাবরই তাঁরা তা এড়িয়ে গেছেন। বরং বাঙালী মুসলমানদের উপর ইসলামী সংস্কৃতির নামে যা চাপানোর চেষ্টা করেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে আরব ও পারস্য দেশের সংস্কৃতি। এ সময়কালে বাঙালী মুসলমানরা বহু মাসিক অর্ধমাসিক ও সাপ্তাহিক পত্র পত্রিকা প্রকাশে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং সীমিত পর্যায়ে হলেও তাতে উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদীতার স্থান পেতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটই কবি গোলাম মোস্তফার বেড়ে ওঠা এবং তাঁর মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
চাকুরি জীবন
বি.এ পাস করার পর তিনি ১৯২০ সালে ব্যারাকপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই স্কুলে থাকা অবস্থায় তিনি ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯২৪ সালে তিনি ব্যারাকপুর স্কুল থেকে কলকাতার হেয়ার স্কুলে বদলি হন। সেখানে তিনি একটানা নয় বছর শিক্ষকতা করার পর কলিকাতা মাদ্রাসায় বদলী হন এবং এক সময় তিনি প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। উল্লেখ্য যে, আজ পর্যন্ত একমাত্র কবি গোলাম মোস্তফা ছাড়া অন্য কোন মুসলমান শিক্ষক বালিগঞ্জ স্কুলের উক্ত পদে আসীন হননি। তিনি ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে একজন উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক।তৎকালে কলিকাতার কোন হাই স্কুলে গোলাম মোস্তফাই ছিলেন প্রথম মুসলমান হেডমাস্টার। তখনকার দিনে এই সম্মান খুব কম মুসলমানই পেয়েছেন। সেখান থেকে কবিকে বদলী করা হয় হুগলী কলেজিয়েট স্কুলে। এরপর ১৯৪০ সালে তাঁকে বাকুড়া জেলা স্কুলে বদলী করা হয়। এ সম্পর্কে কবি কন্যা ফিরোজা খাতুন লিখেছেন: এরপর আব্বা বাঁকুরায় জেলা স্কুলে বদলি হলেন। কলকাতা মানুষের সমুদ্রের মাঝে যেমন জ্ঞানের মুক্তা কুড়াবার আনন্দ পেয়েছেন, তেমনি হুগলীতে নদীর স্রোত বইয়েছেন বিশ্বনবীর প্রবাহে। দেশের বাড়িতে পেতেন সমতার মমতার বিস্তার। বাঁকুড়ার পাহাড় পর্বত ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে কবিকে। সুষনিয়া পাহাড়ে পিকনিকে গিয়ে চূড়ায় বসে কবিতা লেখেন, গান করেন। সেখান থেকে ফরিদপুর বদলি হয়ে যান।
১৯৪৬ সালে তাকে সর্বশেষ ফরিদপুর জেলা স্কুলে বদলী করা হয়।ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকেই তিনি ১৯৫০ সালে দীর্ঘ ত্রিশ বছর একটানা শিক্ষকতার মত মহান পেশার দায়িত্ব পালন করার পর স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।তিনি পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলা ভাষা কমিটির সচিবরূপে কাজ করেন। ১৯৫০ সালে কবি গোলাম মোস্তফা অবসর গ্রহণ করেন এবং নিজের খরিদ করা বাড়ি ঢাকার শান্তিনগরে ১১৮, মোস্তফা মঞ্জিলে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন।
একান্ত নিবিড়ভাবে সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করার জন্যই তিনি নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগেই শিক্ষকতার মহান পেশা থেকে অবসর নেন।
সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা
কবিতা কবির কল্পনা, কবিতা কবির শৈল্পিক উচ্চারণ। কবিতার শিল্পরূপ থেকেই কবির সময়চেতন সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, মিলন বিরহ, স্বপ্ন দ্রোহ ইত্যাদির শিল্পমণ্ডিত প্রকাশ। একই কবিতায় সব রকম অনুভূতি থাকে না, কারণ কবির কবিতায় বিশেষ সময়ে বিশেষ চেতনায় প্রকাশিত হয় বিশেষ বিশেষ ভাব। কবি কল্পনায় ধরা পড়ে সেই ভাব, আপন কবিতার ভাষায় কবি তাকে শিল্পরূপ দেন।
কবি কল্পনার উৎস তাই সমাজ, এবং প্রকাশভঙ্গিতে থাকে তার সময়চেতনা। কবিতায় কবি যা বলতে চান তা পরিবেশ ও অবস্থানগত দ্বিধার কারণে কিংবা যে সমাজ কবি চান, আর যে সমাজে কবি বাস করেন, তার মধ্যের ব্যবধানে অতৃপ্ত ও অসহিষ্ণু হয়ে এমন ভাষা ব্যবহার করেন, যা আঙ্গিকগত উৎকর্ষ পায়।
ভাব আর রূপের এক অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য ঐক্য থেকে জন্ম নেয় একটি কবিতা। এ কবিতা কবি রচনা করেন আপন মহিমায়। জীবনের সত্যকে তিনি যেভাবে আপন সত্ত্বায় ধারণ করেন, সেভাবেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় কবিতার প্রকাশভঙ্গি, শৈলী ও রূপ। সৃষ্টিসম প্রজ্ঞা, জৈবিক ক্ষমতা, সমাজ ও সময়ের প্রভাবের সমন্বয়ে কবির মর্মভূমি কবিতা নির্মাণে অদৃশ্য শক্তির মত কাজ করে যায় এমনকি কবির অজ্ঞাতসারে। তেমনি নিতান্ত অজ্ঞাতে অন্তরালে শিশু বয়সেই কবির মধ্যে কাব্য চিন্তার উন্মেষ ঘটে। পিতা, পিতামহের পুঁথি পাঠ , বিয়ের দাওয়াত রচনা ইত্যাদি থেকে তাঁর মধ্যে কবিত্ব ভাব জেগে ওঠে। মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি গোলাম মোস্তফার অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত।গোলাম মোস্তফা ছিলেন মূলত: কবি। কবি আমার জীবন স্মৃতিতে লিখেছেনÑ আমার বেশ মনে পড়ে, আমার কাব্য জীবনের প্রথম উন্মেষ হয় ১৯০৯ সালে। তখন আমি শৈলকুপা হাইস্কুলে পড়ছি। পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবার পরই কেমন যেন একটা কাব্যিক ভাব আমার মধ্যে এলো।
১৯১১ সালে কবি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটি কাটানোর পর তাঁর এক বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি কবিতায় রচনা করেন। এটিই তাঁর প্রথম রচনা । কবিতাটি হল :
এস এস শীঘ্র এস ওহে ভ্রাতধন
শীতল করহ প্রাণ দিয়া দরশন।
ছুটি ও ফুরাল স্কুল ও খুলিল,
তবে আর এত দেরি কিসের কারণ।
পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম কবিতার নাম আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার (১৯১৩ খৃ.)। কবি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। প্রখ্যাত সাংবাদিক মওলানা মুহম্মদ আকরাম খাঁ সম্পাদিত সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী তে ১৯১৩ সালে কবিতাটি ছাপা হয়। কবিতাটির রচনা ও প্রেক্ষাপটের বর্ণনা করতে গিয়ে কবি বন্দে আলী মিয়া লিখেছেন,পারিপার্শি¦ক পরিবেশ এবং বন্ধুবর্গের প্রেরণায় গোলাম মোস্তফার অবরূব্ধ কাব্যপ্রবাহ ঝর্ণাপ্রবাহের মত বাইরে আত্মপ্রকাশ করল। সেই সময়ে ইউরোপ ভূÑখন্ডে বলকান যুদ্ধে তুরস্ক সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ানদের হাতে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হওয়ায় সমস্ত মুসলিম জাহানে একটা বিপর্যয়তার ছায়া নেমে এসেছিলো। এমন সময়ে হঠাৎ সংবাদ পাওয়া গেল, কামাল পাশা বুলগেরিয়ানদের নিকট থেকে আদ্রিয়ানোপল পুনরূদ্ধার করেছেন। এই খবরে স্বজাতি বৎসল কিশোর কবির প্রাণ আনন্দে নেচে উঠলো। তিনি আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার নাম দিয়ে এক রাতের মধ্যে একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা লিখে ফেললেন। এরপর কবিতাটি তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মাদিতে পাঠিয়ে দিলেন। পরবর্তী সপ্তাহে কবিতাটি মুদ্রিত হলো। কবিতাটি ছিলো এরূপ :
আজিকে প্রভাত কি বারতা নিয়া
ধরায় আসিলো নামিয়া।
সেই সময় কবিতার ছন্দ, ভাব এবং প্রকাশভঙ্গি সবই ছিলো নতুন। তাই এই কবিতাকে কেন্দ্র করে পাঠক মহলে একটা ব্যাপক আলোচনার ঝড় বয়ে গেল।বাংলার মুসলিম সমাজে যে একজন আধুনিক কবির আবির্ভাব হয়েছে একথা সহজেই স্বীকৃতি লাভ করলো। গোলাম মোস্তফাও নব ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন। সেই থেকে তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে শুরু করলেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (১৯১৭ খৃ.), আল এসলাম (১৯১৫ খৃ.), সাধনা ( ১৯১৬ খৃ.), সহচর ( ১৯১৫ খৃ.), সওগাত ( ১৯১৭ খৃ.), মাসিক মোহাম্মদী (১৯১৬ খৃ.), ইসলাম দর্শন (১৯২৭ খৃ.), মাহে নও সত্য বার্তা (১৯৩৮ খৃ.), মোয়াজ্জিন ( ১৯৩৮ খৃ.) প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকায় এসব কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। আল এসলাম (২য়ভাগ, ১৩২৩ সাল), (তয় ভাগ, ১৩২৪ সাল), (৪র্থ ভাগ, ১৩২৫ সাল), (৫ম ভাগ, ১৩২৬ সাল) পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
মৌলিক রচনা এবং পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজী সাহিত্যেও তাঁর প্রচুর দক্ষতা ছিল। সমসাময়িক The Musalman, The star of India, The Morning News, The Pakistan Observer, The Down প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি অনেক তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এগুলো পাঠ করলে ইংরেজী ভাষার উপরও যে কবির যথেষ্ট দখল ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
Morning News তাঁর সর্ম্পকে মন্তব্য করেছিলো He is also a fine prose writer both in Bengali and English. বাঙালী মুসলমানের জাতীয় জাগরণের পথিকৃতদের অন্যতম কবি গোলাম মোস্তফা জীবনের প্রথম থেকেই পরিকল্পিতভাবে তাঁর লেখনি চালনা করেন।
তিনি নিজেই লিখেছেন: “যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানের অবক্ষয়ের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যের না ছিলো কোন স্বাতন্ত্র, না ছিলো কোন স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির মননশক্তি, ঐতিহ্য, ধ্যান ধারণা ও আশা আকাংক্ষা রূপায়িত হয় তাঁর মাতৃভাষার মধ্যে। সেই হিসেবে বাংলার মুসলমানদের কোন সাহিত্যই তখন রচিত হয়নি। আমি তাই ছোটবেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলিমের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও, আমার মনে জেগেছিলো আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দূর্জয় আকাঙ্খা। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তাগিদে নয়Ñসহজ ভাবেই আমি বাংলা সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামী কৃষ্টির রূপায়ণ।”
উক্ত দৃষ্টি ভঙ্গিকে সামনে রেখেই ১৯১৩ সালের প্রথম লেখা প্রকাশ থেকে তাঁর পরবর্তী পঞ্চাশ বছরকাল তাঁর লেখালেখির গতি অব্যাহত ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুতোষ সাহিত্য, গান, জীবনী, অনুবাদ সাহিত্য লিখেছেন। পেশাগতভাবে একজন শিক্ষক গোলাম মোস্তফা তাঁর দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার কল্যাণেই শিশু ও কিশোর মনস্তত্ত্বের সংগে ছিলেন নিবিড়ভাবে পরিচিত। এ কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে বহু স্মরণীয় শিশু ও কিশোরÑকবিতা রচনা। তাঁর রচিত আলোকমালা (১৯৫৩ খৃ.), পথের আলো (১৯৫৩ খৃ.), নতুন আলো (১৯৫৪খৃ.) এবং আলোকমঞ্জুরী (১৯৫৪খৃ.) সিরিজগুলো শিশু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান।
ধর্ম বিশ্বাসই গোলাম মোস্তফার চিন্তার ভিত্তিভূমি। জগত ও জীবনের প্রতিটি সত্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রগাঢ় ইসলামী ভাবধারায় সম্পৃক্ত।গোলাম মোস্তফার সর্বশ্রেষ্ট অবদান বিশ্বনবী (১৯৪২ খৃ.) বহুল সমাদৃত। তাঁর লেখালেখির পঞ্চাশ বছরে প্রকাশিত
দুইটি উপন্যাস
১. রূপের নেশা (উপন্যাস, ১৩২৬ খৃ.), ২. ভাঙ্গা বুক (উপন্যাস, ১৯২১ খৃ.)।
আটটি মৌলিক কাব্য
১. রক্ত রাগ (কবিতা, ১৯২৪ খৃ.), ২. খোশরোজ (কবিতা, ১৯২৯ খৃ.), ৩. সাহারা (কবিতা, ১৯৩৫ খৃ.), ৪. হাস্না হেনা (কবিতা, ১৯২৮খৃ.), ৫. কাব্যকাহিনী (কবিতা, ১৯৩৮ খৃ.), ৬. তারানা ই পাকিস্তান (কবিতা, ১৯৫৬ খৃ.), ৭. বনি আদম, প্রথম খণ্ড (কবিতা, ১৯৫৮ খৃ.), ৮. আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি (কিশোর কবিতা, ১৯৮০ খৃ.)।
৫ টি কাব্যানুবাদ ও ১টি গল্প সংকলন
১. মোসাদ্দস ই হালী (অনুবাদ কবিতা, ১৯৪১ খৃ.), ২. কালাম ই ইকবাল (কবিতা, ইকবাল কাব্যের অনুবাদ, ১৯৫৭ খৃ.), ৩. শিকওয়া (অনুবাদ কবিতা, ১৯৬০ খৃ.), ৪. জবাব ই শিকওয়া (অনুবাদ কবিতা, ১৯৬০ খৃ.), ৫. আল কুরআন (বাংলা কাব্য অনুবাদ, ১৯৫৭ খৃ.), জয় পরাজয় (গল্প, ‘রাসাইলু ইখওয়ানুস্ সাফা ১৯৬৯ খৃ. ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ)।
৩টি কাব্য সংকলন
১.বুলবুলিস্তান (কাব্য সংকলন, ১৯৪৯ খৃ.), ২. কাব্য গ্রন্থাবলী, ১ম খণ্ড (কবিতা আবদুল কাদির সম্পাদিত, ১৯৭১ খৃ.), ৩. কাব্য সংকলন (কবিতা সৈয়দ আলী আশরাফ সম্পাদিত, ১৯৬০ খৃ.)।
৪টি জীবনী গ্রন্থ
১.বিশ্বনবী (জীবনী, ১৯৪২ খৃ.), ২. মরু দুলাল (জীবনী, ১৯৪৮ খৃ.), ৩. বিশ্ব নবীর
বৈশিষ্ট্য (জীবনী, ১৯৬০ খৃ.), ৪. হযরত আবুবকর (জীবনী, ১৯৬৫ খৃ.)।
২টি ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ
১. ইসলাম ও জিহাদ ( ১৯৪৭ খৃ.), ২. ইসলাম ও কমিউনিজম (ধর্ম, ১৯৪৯ খৃ.)।
৩টি রাজনীতি ও ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ:
১. ইতিহাস পরিচয় (রাজনীতি, পাঠ্য, ১৯৪৭ খৃ.); ২. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (রাজনীতি, তা: বি:)। ৩.অবিস্মরণীয় বই, (ইতিহাস সম্পাদনা, ১৯৬০ খৃ.);
১টি প্রবন্ধ সংকলন:
আমার চিন্তাধারা (প্রবন্ধ সংকলন, ১৯৬২ খৃ.), ও
১টি গানের সংকলন:
গীতি সঞ্চয়ন (গান, ফিরোজা খাতুন সম্পাদিত: ১৯৬৫ খৃ., ১৯৬৮ খৃ. )।
পাঠ্য পুস্তক :
আলোক মঞ্জরী, (১৯৫৩ খৃ.), পথের আলো (১৯৫৩ খৃ.), নতুন আলো (১৯৫৪খৃ.), ইসলামী নীতিকথা (১৯৫৩ খৃ.), মনিমুকুর, ইতিহাস পরিচয় (১৯৪৭ খৃ.), ইতিকাহিনী, নতুন বাংলা ব্যকরণ, নতুন ব্যকরণ, মঞ্জু লেখা ইত্যাদি।
গ্রন্থসমূহ থেকেই বোঝা যায় কবি গোলাম মোস্তফা শুধু একজন কবিই ছিলেন না, সাহিত্যের নানা শাখায় ছিলো তাঁর স্বতস্ফূর্ত বিচরণ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন চৌকষ লেখক। তাঁর অবদান সাহিত্যের নানা শাখায় পল্লবিত হয়ে আছে। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, সাহিত্য, জীবনী, গবেষণা, পাঠ্যপুস্তক, চিন্তাধারাসহ সাহিত্যের সকল বিভাগে তাঁর অবদানঅপরিসীম। তিনি তাঁর কাব্যের বিরাট একটা অংশ, গদ্যের বেশির ভাগ জুড়ে ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যয় করে গেছেন। ইসলামী ঐতিহ্য চেতনায় নিজেকে ব্যপ্ত রেখেছেন। কবি গোলাম মোস্তফার প্রতিভা শুধু লেখনি মুখেই প্রকাশ পায়নি, তাঁর সাহিত্য রচনায় তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর শেষ অবদান হযরত আবু বকর সিদ্দিক [রা.] এর জীবনী। একজন কবি, একজন সাহিত্যিক, একজন প্রবন্ধকার, একজন জীবনীকার, একজন উপন্যাসিক, একজন গীতিকার, সর্বোপরি একজন লেখক হিসেবেএখানেই তিনি সার্থক।
তাঁর রচিত শিশুদের মন মাতানো অসংখ্য ছড়া/কবিতা ইত্যাদি রয়েছে-
ক. আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।
  ……………………………………..
 ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।(কিশোর)।
খ. খুকুমনি জনম নিল যেদিন মোদের ঘরে,
  পরীরা সব দেখতে এল কতই খুশী ভরে। (কিশোর)।
গ.  এই করিনু পণ মোরা এই করিনু পণ
ফুলের মতো গড়ব মোরা মোদের এই জীবন।
হাসব মোরা সহজ সুখে   গন্ধ রবে লুকিয়ে বুকে
মোদের কাছে এলে সবার   জুড়িয়ে যাবে মন। (শিশুর পণ)।
ঘ.  নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।
রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছ ধুম,
বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম।
*****************************
  ধূলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাদার পিঠে,
মিছিমিছি খেয়া সবাই, বলে- বেজায় মিঠে।
এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে,
পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে। (বনভোজন)।
বিটিভির এক সময়ের জনপ্রিয় ‘নতুন কুঁড়ি’র সূচনা সঙ্গীত কবির কিশোর কবিতা হতেই নেওয়া হয়েছে।
কবি গোলাম মোস্তফা আমাদের সকলের মনমত করে সূরা ফাতিহার ছন্দোবদ্ধ ভাবানুবাদ লিখেছেন,
অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি
বিচার দিনের স্বামী।
যত গুণগান হে চির মহান
তোমারি অন্তর্যামী।
তাছাড়া তাঁর লেখা হামদ, নাত আমাদের দেশের ছেলে বুড়ো সকলের প্রিয়।
তাঁর প্রকাশিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলি হচ্ছে রক্তরাগ, হাস্নাহেনা, খোশরোজ, সাহারা, কাব্যকাহিনী, এবং অনুবাদগ্রন্থ মুসাদ্দাসই হালী, তারানা ই পাকিস্তান, বনি আদম, অনুবাদ কাব্য-আল কুরআন, কালামে ইকবাল ও শিকওয়াও জবাব ই শিকওয়া এবং কবিতা সংকলন বুলবুলিস্তান। এছাড়া লিখেছেন ‘বিশ্বনবী’র মত পাঠক নন্দিত বিশালাকার গদ্য গ্রন্থ। তিনি কবি আল্লামা ইকবালের গোঁড়া ভক্ত ছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি নজরুল ইসলামকে নিয়ে এ ছড়াটি লিখেছেন-
কাজী নজরুল ইসলাম
বাসায় একদিন গেছিলাম
ভায়া গান গায় দিনরাত
সে লাফ দেয় তিন হাত
প্রাণে হর্ষের ঢেউ বয়
ধরার পর তার কেউ নয়।
তিনি বাংলা একাডেমী, টেক্সট বুক বোর্ড, করাচীর বুলবুল একাডেমী, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি(১৯৪৯), পাকিস্তান জাতীয় গ্রন্থাগারের গভর্নিং বডি এবং পাকিস্তান লেখক সংঘের সদস্য ছিলেন।
১৯৬০ সালে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব, প্রেসিডেন্ট পদক ও আরো পাঁচ হাজার টাকা নগদ পুরস্কার লাভ করেন। ঐ ১৯৬০ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-পাক সাংস্কৃতিক সম্মেলনে এবং ১৯৬১ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর অধিবেশনে তিনি পাকিস্তানী লেখকবৃন্দের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৩ অক্টোবর ১৯৬৪ সালে সেরিব্রাল থ্রম্বসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই মহান কবি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাঁর রূহের মাগফিরাত দিন।

No comments:

Post a Comment