Tuesday, October 20, 2015

ইসমাইল হোসেন সিরাজী

আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া,
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া,
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া,
পূত বিভূ নাম স্মরণ করি।
সিরাজগঞ্জ শহরের ছোট্ট এক কামরায় বসে লিখে চলেছেন এক তরুণ তার আপন কওমকে জাগিয়ে তোলার জন্য। লিখে চলেছেন বৃটিশ বেনিয়াদের এদেশ হতে চিরতরে উৎখাত করার জন্য। এই বেনিয়া গোষ্ঠী সমস্ত ভারত উপমহাদেশ মুসলমানদের কাছ হতে ছিনিয়ে নেয়। ক্ষোভে দুঃখে মুসলমানগণ ইংরেজদের প্রবর্তিত অনেক কিছুই ত্যাগ করে। এমনকি ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ হতেও নিজেদেরকে সরিয়ে রাখে। অপরদিকে হিন্দুরা এ সুযোগ গ্রহণ করে শিক্ষা দীক্ষায় মুসলমানদের চেয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। মুসলমানরা হয়ে পড়ে পঙ্গু কি শিক্ষা দীক্ষায়, কি সম্পদ বৈভবে। ঠিক এ সময়েই কলম তুলে নেন সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী। ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই তারিখে তিনি তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্গত সিরাজগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ আবদুল করীম এবং মাতার নাম নুরজাহান বেগম। তারা উভয়েই ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার মানুষ।
শিশু ইসমাইল হোসেনের লেখাপড়ার প্রথম সবক দেন তাঁর মা নূরজাহান খানম। নূরজাহান খানম তাঁর শিশুপুত্রকে প্রথমেই কোরআন শিক্ষা দেন। কোরআন শিক্ষা শেষ হলে তাঁকে মধ্য ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করা হয়। মেধাবী ইসমাইল হোসেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সিরাজগঞ্জের বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে এ সম্ভাবনাময় তরুণ লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আর অগ্রসর হতে পারেন নি। তাছাড়া স্বদেশের পরাধীনতা, সমগ্র মুসলিম জাহানের দুর্দশার জন্য বেদনাবোধ হতে সৃষ্টি উৎকন্ঠাও তাঁকে স্কুলের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থাকতে দেয় নি। তোমরা জানলে আশ্চর্য হবে যে, তিনি এ সময়ে নির্যাতিত অবহেলিত, লাঞ্চিত ও পদদলিত মুসলিম জাতির জন্য বেদনাবিধুর, এতই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে তুরস্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এ যাত্রায় তিনি তুরস্কে যেতে পারেন নি ঠিক কিন্তু সেই যে মুসলিম জাহানের কল্যাণের মানসে ঘর হতে বের হলেন আর কখনই সুবোধ বালকের মত ঘরে বসে থাকেন নি। অবশ্য তিনি পরবর্তীকালের তাঁর বাল্যকালের স্বপ্নের তুরস্কে গিয়েছিলেন তা অনেক পরের কথা।
ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সবচেয়ে পরিচিত কাব্যগ্রন্থ হল ‘অনল প্রবাহ’। এটি ১৮৯৯ সনে মুনসী মেহেরউল্লা প্রথম প্রকাশ করেন। পুস্তিকাটি এত জনপ্রিয় ছিল যে ১৯০০ সালে আরো কিছু কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি আবার প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯০৮ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। আর এ সময়ই ‘অনল প্রবাহ’ ও লেখক বৃটিশ রাজশক্তির আক্রমণের শিকার হন। ‘অনল প্রবাহ’ বাজেয়াপ্ত হয় এবং লেখকের দু’বছর কারাদন্ড হয়। তিনিই প্রথম কবি যার কাব্যগ্রন্থ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় এবং তিনিই বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে কারাদন্ড ভোগকারী উপমহাদেশের প্রথম সাহিত্যিক। সিরাজীর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হল ‍উচ্ছ্বাস, উৎসব, উদ্বোধন কাব্য, মহাশিক্ষা কাব্য, স্পেন বিজয় কাব্য, প্রেমাঞ্জলী(গীতিকাব্য), সঙ্গীত সঞ্জীবনী ইত্যাদি।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও মিথ্যা অপপ্রচার করতো তখন হিন্দু কবি সাহিত্যিকরা। বিশেষ করে চরম মুসলিম বিদ্বেষী ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার লেখায় সুপরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের হেয় করার চেষ্টা করতেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী এ সমস্ত কুৎসিৎ লেখার জবাব দিতে গিয়ে উপন্যাসও রচনা করেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে তারাবাই, ফিরোজা বেগম, নুরুদ্দীন, রায়নন্দিনী ও বংকিম দুহিতা। না, জবাব দিতে গিয়ে সিরাজী প্রতিআক্রমণ বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি বেছে নেননি। সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উপন্যাসে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘রায় নন্দিনী’।
সিরাজী রচিত কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী ও সঙ্গীত বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সংখ্যা ৩২টি। এগুলো হলো- কাব্যগ্রন্থ উচ্ছ্বাস (১৯০৭), নব উদ্দীপনা (১৯০৭), উদ্বোধন (১৯০৮), স্পেন বিজয় কাব্য (১৯৮৪), মহাশিক্ষা কাব্য প্রথম খন্ড (১৯৬৯), মহাশিক্ষা কাব্য দ্বিতীয় খন্ড (১৯৭১)। উপন্যাস- রায়নন্দিনী (১৯১৫), তারাবাঈ (১৯১৬), নূরউদ্দীন (১৯১৯)। প্রবন্ধ গ্রন্থ- মহানগরী কর্ডোভা (১৯০৭), স্ত্রীশিক্ষা (১৯০৭), আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪), সুচিন্তা প্রথম খন্ড (১৯১৬), তুর্কি নারী জীবন (১৯১৩), ভ্রমণ কাহিনী- তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১৩)। সঙ্গীত গ্রন্থ- সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬), প্রেমাঞ্জলী (১৯১৬) প্রভৃতি। অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- সুধাঞ্জলী, গৌরব কাহিনী, কুসুমাঞ্জলী, আবে হায়াৎ, কাব্য কুসুমোদ্যান, পুস্পাঞ্জলী। অসমাপ্ত উপন্যাস- বঙ্গ ও বিহার বিজয় এবং জাহানারা।
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ কলিকাতা ২/১ ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে, সিরাজী পাবলিক লাইব্রেরী ও ফ্রি রিডিং রুম- এর উদ্বোধন করা হয়। উক্ত দ্বারোঘাটন অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘সিরাজী সাহেব ছিলেন আমার পিতৃতুল্য। তিনি আমাকে ভাবিতেন জ্যেষ্ঠ পুত্র-তুল্য। তাঁহার নিকট যে স্নেহ আমি জীবনে পাইয়াছি তাহা আমার জীবনের পরম সঞ্চয়। ফরিদপুর কনফারেন্সে তাঁহার সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার সমগ্রজীবনই ছিল অনল প্রবাহ এবং আমার রচনায় সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গের প্রকাশ আছে। সাহিত্যিক ও রাজনীতিক ছাড়াও আমার চোখে তিনি প্রতিভাত হয়েছিলেন এক শক্তিমান দরবেশ রূপে। মৃত্যুকে তিনি ভয় করেন নাই, তুরস্কের রণক্ষেত্রে তিনি সেই মৃত্যুর সঙ্গে করিয়াছিলেন মুখোমুখি। তাই অন্তিমে মৃত্যু তাঁহার জন্য আনিয়া দিয়াছিল মহাজীবনের আস্বাদ।’
বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্ভাগ্য যে আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা মহান পুরুষ সিরাজীকে হীনমন্যতার কারণে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। দেশের মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্যসূচিতে সিরাজী রচনাবলী উপেক্ষিত। সিরাজীর লেখা থেকে বঞ্চিত এদেশের শিক্ষার্থীরা। সিরাজী সম্পর্কে তরুণ সমাজকে জানতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ সিরাজীর অনলবর্ষী  বক্তৃতায় প্রকম্পিত হয়েছিলো ব্রিটিশ সিংহাসন। তাঁর কণ্ঠ ও লেখা থেকে বারুদের গন্ধ বের হতো। তাঁর বক্তৃতায় জেগে ওঠেছিলো লাখো লাখো তরুণ। সেখানে মুসলিম বা হিন্দু বলে কোনো প্রশ্নের সৃষ্টি হয় নাই। ব্রিটিশ রাজ শুধু তাঁকে কারাবন্দীই করেনি, তার কবিতাও নিষিদ্ধ করেছিলো। সেই স্বাধীনচেতা মহাকবিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অবমূল্যায়ন করছেন। যারা মুসলমানদেরকে লাইভস্টক বা গৃহপালিত পশু বলে আখ্যায়িত করছে, যারা আমাদেরকে কাক পক্ষী, দস্যু, তস্কর, দানব, অসুর, অনার্য, ইতর, নরপশু, ডাকাত বলে গালি দিয়েছে তাদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী ঘটা করে পালন করা হয়। তাদের লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের। অথচ সিরাজীর মত মহানায়কের রচনাবলী পাঠ্য বহির্ভূতই থেকে যাচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন দুর্বিষহ অবস্থার প্রেক্ষিতে সিরাজীর মতো বিপ্লবী পুরুষের প্রসঙ্গ টেনে আনা অতীব জরুরী। ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশী জাতি সৃষ্টির এই গঠনকালে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উদারতা, দৃঢ়তা, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাতন্ত্র্যবাদ, ঐতিহ্য চেতনা, সংস্কৃতি চেতনা, বিজ্ঞান-ইতিহাস ও সাহিত্য-চেতনা প্রভৃতি থেকে প্রেরণা আহরণ একান্ত কর্তব্য। ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত সারা উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে যে জাতীয় ঐক্যবোধ, জাগরণ স্পৃহা আপন জাতীয় সত্ত্বার পরিচয় ফুটিয়ে তোলার আকাক্মখা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যে প্রতিষ্ঠা অর্জনের প্রয়াস তীব্র আবেগে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবোধের প্রেক্ষিতে সেই উদ্যম নিষ্ঠা ও কর্ম-চাঞ্চল্য একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠেছে। আবশ্যক হয়ে উঠেছে আজ আবার নতুন করে ঘনিয়ে ওঠা বিভ্রান্তির, দিশাহীনতার দিগন্তের কালো আবরণ ভেদ করে আলোকবন্যা আবাহনের জন্য নতুন করে গর্জে ওঠা হাজার হাজার সিরাজীর।’
মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই দুরারোগ্য পৃষ্ঠব্রণ রোগে আক্রান্ত হয়ে মুসলিম বিশ্বের এই মহান পুরুষ ইন্তিকাল করেন। জীবনের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বপ্রকার অনাচার, কদাচার, কুসংস্কার, অন্যায় ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সিংহের মত লড়ে গেছেন। না কোথাও কোন কারণে তিনি মাথা নত করেন নি।

1 comment:

  1. সিরাজী থেকে বঙ্গবন্ধু, নজরুলকে যিনি পুত্রতুল্য স্নেহ করতেন এবং নজরুলও তাঁকে পিতৃতূল্য শ্রদ্ধা করতেন, নজরুলকে গুরু মেনে বঙ্গবন্ধ নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়ার ছলে বাংলাদেশে নিয়ে এসে আর যেতে দেননি এবং জাতীয় কবির মর্যাদায় আসিন করেছেন।

    ReplyDelete