Tuesday, October 20, 2015

মহাকবি আল্লামা ইকবাল

‘আরব হামারা চীন হামারা হিন্দুস্তাঁ হামারা
মুসলিম হ্যায় হাম,–ওতন হ্যায়
     সারা জাঁহা হামারা।’
কোন কোন মানুষকে আল্লাহ বিশেষভাবে সৃষ্টি করেন দেশ ও জাতির খেদমতের জন্য। শত ঝড়ঝঞ্জা বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সেসব মানুষ তাঁদের কাজ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে যান। আমরা আজকে এমন এক ব্যক্তিত্ব ও কবি পুরুষ সম্বন্ধে আলোচনা করবো।
তোমরা হয়ত কোন না কোনভাবে শুনে থাকবে মহাকবি আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে। হয়ত কথাটা এজন্য বললাম যে, বর্তমানে আমাদের দেশে কবি ইকবালকে জানার তেমন সুযোগ নেই। সত্যি কথা বলতে কি এই মহান কবিকে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কবি ইকবাল পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট নামক স্থানে ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ নুর মোহাম্মদ এবং মাতার নাম ইমাম বীবী। কবির পিতা মাতা উভয়ই অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার মানুষ ছিলেন। কবির পূর্বপুরুষগণ কাশ্মীরবাসী সাপ্রু গোত্রীয় ব্রাহ্মণ পন্ডিত ছিলেন। তাঁরা সুলতান জয়নুল আবেদীন ওরফে বুদ শাহ(১৪২১-১৪৭৩ খৃ) এর রাজত্বকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দাদা শিয়ালকোটে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ষাট বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
কবির পিতা শেখ নূর মোহাম্মদ উচ্চশিক্ষিত কোন মানুষ ছিলেন না কিন্তু তিনি একজন স্বনামধন্য পন্ডিত ছিলেন। যার কারণে শামসুল উলামা সৈয়দ মীর হাসান তাঁকে(কবির পিতাকে) অশিক্ষিত দার্শনিক উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
ইকবালের জন্মের ব্যাপারে কথিত আছে যে, একদিন তাঁর পিতা স্বপ্নে দেখলেন, আকাশচারী একটি অসম্ভব সুন্দর কবুতর তার কোলে এসে পড়ল। পরে তিনি স্বপ্ন বিশারদের কাছে জানতে পারলেন অদূর ভবিষ্যতে তিনি একজন ভাগ্যবান পুত্রের বাপ হতে যাচ্ছেন। আরও কথিত আছে যে, সদ্যজাত ইকবালকে যখন পিতা নূর মোহাম্মদের কোলে দেওয়া হয় তখন তিনি সদ্যজাত শিশুপুত্রকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “বড় হয়ে দ্বীনের খেদমত করলে বেঁচে থাক, নচেৎ এখনি মরে যাও।” বুঝতে পারছ তাঁর স্নেহময় পিতা তাঁর কাছ হতে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতের জন্য কি আশা করেছিলেন?
পিতা নূর মোহাম্মদের ইচ্ছা ছিল পুত্রকে মাদরাসায় পড়ানোর কিন্তু উস্তাদ শামসুল উলামা মীর হাসানের পরামর্শে তাঁকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রাইমারী শিক্ষা শেষ হলে তাঁকে শিয়ালকোট স্কচ মিশন স্কুলে ভর্তি করা হয়। এ স্কুল হতে তিনি ১৮৯৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। স্কচ স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন তিনি একদিন দেরীতে ক্লাসে আসেন, ক্লাস টিচার তাঁর দেরিতে ক্লাসে আসার কারণ জানতে চাইলে বালক ইকবাল তৎক্ষণাত উত্তর দেন, “ইকবাল(সৌভাগ্য) দেরিতে আসে স্যার।” উত্তর শুনে পন্ডিত শিক্ষক তো ‘থ’। তিনি যে শুধু উপস্থিত বুদ্ধিতে দক্ষ ছিলেন তা নয়। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। ১৮৮৮, ১৮৯১ ও ১৮৯৩ সালে যথাক্রমে প্রাথমিক বৃত্তি, নিম্ন মাধ্যমিক বৃত্তি ও প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি স্বর্ণপদক ও মাসিক বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৯৩ সালে স্কচ মিশন স্কুল কলেজে উন্নীত হলে ইকবাল এখানে এফ. এ. শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৯৫ সালে অনুষ্ঠিত এফ.এ. পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং যথারীতি বৃত্তিসহ স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৮৯৫ সালে তিনি শিয়ালকোট হতে লাহোরে এসে লাহোর সরকারী কলেজে বি.এ ভর্তি হন। এখানে একটা খবর দিয়ে রাখি, ইকবাল যখন বি.এ পড়ার জন্য পিতার নিকট অনুমতি চাইলেন তখন তাঁর পিতা তাঁকে বলেছিলেন, ‘ছাত্র জীবন শেষ করার পর অবশিষ্ট জীবন ইসলামের খিদমতে ওয়াকফ করে দিতে হবে।’
হ্যাঁ, তিনি তাতেই রাজী হয়েছিলেন। আর সত্যি সত্যিই তাঁর সারাটা জীবন ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। লাহোর সরকারী কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি টি.ডব্লউ এর মত ভূবন বিখ্যাত একজন সুযোগ্য শিক্ষক পান যিনি ছিলেন আরবী ভাষায় সুপন্ডিত, দর্শনের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক। প্রতিভাবান ইকবালকে ছাত্র হিসেবে পেয়ে আরনল্ড সাহেব তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন এবং মনের মত করে গড়ে তুলেছিলেন। ১৮৯৭ সালে তিনি আরবী ও ইংরেজিতে সমগ্র পাঞ্জাবে প্রথম স্থান নিয়ে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যে কারণে তিনি এবার দুটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এরপর ১৮৯৯ সালে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাস করেন। সাথে সাথে তিনি লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে ইতিহাস ও দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এর সামান্য কিছুকাল পরই তিনি লাহোর সরকারী কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজের ইংরেজি ও দর্শনশাস্ত্রের খন্ডকালীন সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এ সময়ে উর্দু ভাষায় অর্থশাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁর সর্বপ্রথম পুস্তক রচনা করেন। তাঁর জীবন ছিল ছকে বাঁধা। এ সম্বন্ধে ইসলামী বিশ্বকোষ লিখেছে, “তিনি ভোরে ওঠে ফজরের সালাত আদায় করতেন, অতঃপর উচ্চস্বরে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। তারপর কিছুক্ষণ শরীরচর্চা করতেন এবং কিছু না খেয়ে কলেজে যেতেন। দুপুরে বাড়ি ফিরে আহার করতেন। অনেক সময় গভীর রাতে ওঠে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। একবার তিনি একাধারে দুই মাস এই রাত্রিকালীন সালাত আদায় করেন।’
১৯০৫ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মানসে লন্ডন গমন করেন। পথিমধ্যে তিনি খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, সূফী কবি আমীর খসরু ও মহাকবি গালিবের মাযার জিয়ারত করেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি দর্শনশাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। এ সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পান বিশ্ব খ্যাত দার্শনিক ডঃ এম সি ট্যাগার্টকে। এরপর তিনি পশ্চিম ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। শেষে জার্মানীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারস্যের দর্শন শাস্ত্র বিষয়ক সন্দর্ভ লিখে ১৯০৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। এরপরের বছর লিংকন ইন হতে ব্যারিস্টারী পাস করেন। এ সময় তাঁর প্রিয় শিক্ষক স্যার আর্নল্ড লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবীর অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বিশেষ কারণে কয়েক মাসের ছুটিতে গেলে ইকবাল ৬ মাসের জন্য তাঁর স্থানে আরবীর অস্থায়ী অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
১৯০৮ সালের ২৭ শে জুলাই তিনি দেশে ফিরে এলে লাহোরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করেন। তিনি লাহোরে ফিরে স্বপদে পুনর্বহাল হন এবং সরকারের অনুমতিক্রমে আইনব্যবসা শুরু করেন। অবশ্য দেড় বছর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে তিনি আইনব্যবসা শুরু করেন। তবে একটা কথা জেনে রাখা দরকার, তিনি কখনই মাসিক খরচের পরিমাণ টাকা রোজগারের পর কোনও মোকদ্দমা গ্রহণ করতেন না। আরও একটা কথা, তিনি যদি বুঝতেন কোন মোকদ্দমায় মক্কেলের তেমন কোন উপকার করতে পারবেন না তা’হলেও তিনি সে কেস গ্রহণ করতেন না। শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি এভাবে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ সালে শিয়ালকোটের এক কবিতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর কবি প্রতিভার বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। এরপর তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখে হায়দারাবাদের প্রখ্যাত কবি দাগের নিকট পাঠিয়ে দেন সংশোধনের জন্য। কবি দাগ কিশোর কবির এ কবিতাগুলি পেয়ে মনোযোগ সহকারে পড়েন ও চমৎকার একটি মন্তব্য লিখে পাঠান। কবি দাগ লিখেছিলেন, ‘এ কবিতাগুলি সংশোধন করার কোন দরকার নেই। এগুলো কবির স্বচ্ছ মনের সার্থক, সুন্দর ও অনবদ্য ভাব প্রকাশের পরিচয় দিচ্ছে।’ কবি ইকবাল এ চিঠি পেয়ে তো খুব উৎসাহ পেলেন। তাঁরপর হতে চললো তাঁর বিরামহীন কাব্যসাধনা। এরপর ১৯০০ সালে তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত আঞ্জুমানে হিমায়েতে ইসলাম-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় জীবনের প্রথম জনসমক্ষে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নালা ইয়াতীম’ বা অনাথের আর্তনাদ পাঠ করেন। কবিতাটি পড়ার পর চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। মানে কবিতাটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, তাৎক্ষণিকভাবে কবিতাটি ছাপা হয় এবং এর প্রতিটি কপি সে সময় চার টাকা দামে বিক্রি হয়। বিক্রয়লব্ধ প্রচুর পরিমাণ টাকা ইয়াতিমদের সাহায্যার্থে চাঁদা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯০১ সালে তিনি ছোটদের জন্য লেখেন-মাকড়সা ও মাছি, পর্বত ও কাঠবিড়ালি, শিশুর প্রার্থনা, সহানুভূতি, পাখীর নালিশ, মায়ের স্বপ্ন প্রভৃতি কবিতা।
এরপর তিনি দু’হাতে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ছিল, ‘স্বদেশপ্রেম, মুসলিম উম্মাহর প্রতি মমত্ববোধ, ইসলামের শ্বাশত আদর্শে তাওহীদভিত্তিক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, জাতির উত্থান-পতন, দলীয় কলহ ও অন্তর্দ্বন্ধ নিরসন প্রভৃতি বিষয় কবিতায় স্থান পেতো। ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে তিনি বেলালী সুরে আহবান জানাতেন ক্লান্তিহীনভাবে। স্বকীয় আদর্শের সন্ধানে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে তোলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল।’
তাঁর কাব্যে এ ধরনের চিরন্তন আবেদন থাকার কারণে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হন। নানামুখি প্রতিভার অধিকারী এ মহান ব্যক্তিত্ব তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সর্বমহল হতে অকুন্ঠ সম্মান অর্জন করেন। মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন হিন্দু অধ্যাপক বলেছিলেন, “মুসলমানগণ ইকবালকে লক্ষবার তাঁদের সম্পদ বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু তিনি কোন ধর্ম বা শ্রেণীবিশেষের সম্পদ নন-তিনি একান্তভাবে আমাদেরও।’’
১৯০১ সালে ‘হিমালাহ’ নামক কবিতাটি তৎকালীন সময়ের উর্দু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘মাখযানে’ ছাপা হয়। এটিই পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম কবিতা। মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে তিনি এসময় অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। ১৯০৩ সালে লাহোর হতে অর্থনীতির ওপর তাঁর প্রথম পুস্তক ‘আল  ইলমুল ইকতেসাদ’ প্রকাশিত হয়।
১৯২৪ সালে ‘বাঙ্গেদারা’ বা ঘন্টাধ্বনি নামক তাঁর বিখ্যাত কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত এ গ্রন্থটির বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদী’ বা ব্যক্তিত্বের গূঢ় রহস্য। এ কাব্যগ্রন্থটি ১৯২০ সালে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন ডঃ আর.এ.নিকোলসন। সাথে সাথে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে মহাকবি ও বিশ্বকবি আল্লামা ইকবালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালে ‘আসরার-ই-খুদী’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। বিশ্বের বহু ভাষায় এ কাব্যগ্রন্থটি অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
১৯১১ ও ১৯১২ সালে পঠিত তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কবিতা ‘শিকওয়াহ’ বা অভিযোগ ও ‘জওয়াব-ই-শিকওয়াহ’ বা অভিযোগের জবাব উর্দু ভাষায় রচিত। এ দীর্ঘ দুটি কবিতার কাব্যগ্রন্থ দু’টির বাংলা ভাষায় একাধিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় রচিত ‘পায়াম-ই-মাশরিক’ প্রাচ্যের বাণী কাব্যগ্রন্থটি। গ্রন্থটি আরবী, ইংরেজী, তুর্কী, জার্মান ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় ‘রামূয-ই-বেখুদী’ বা আত্মবিলোপের গুঢ়তত্ত্ব কাব্যগ্রন্থটি। মূলত এ গ্রন্থটি ‘আসরারে খুদী’র দ্বিতীয়াংশ। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ গ্রন্থটির ৮৪ তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘বালে জিবরীল’ বা জিবরাঈলের ডানা উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘দরবারে কালীম’ বা মূসার লাঠির আঘাত কাব্যগ্রন্থটি। উর্দু ভাষায় রচিত এ কাব্যগ্রন্থটি আরবী ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েও প্রকাশিত হয়।
এর আগে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘যাবুরে আজম’ বা প্রাচ্যের ধর্ম সংগীত কাব্যগ্রন্থটি। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় ফারসী ভাষায় রচিত ‘জাবীদ নামা’ বা অমর লিপি কাব্যগ্রন্থটি। এমনিভাবে একের পর এক তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত তিনি প্রাচ্যের সেই ভাগ্যবান কবি ব্যক্তিত্ব যার রচনা এত ব্যাপকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সত্যিই যদি বিশ্বকবি বিশেষণে কাউকে বিশেষিত করতেই হয় তবে সে সম্মানের অধিকারী নিঃসন্দেহে কবি আল্লামা ইকবাল। কবি নিজেও ছিলেন বহু ভাষাবিদ পন্ডিত। তিনি উর্দু, ফারসী, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় লেখনি চালিয়েছেন।
কবি The Development of Metaphysics in Iran বা ‘প্রজ্ঞান চর্চায় ইরান’ এই বিষয়ের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯০৮ সালে লন্ডন হতে এ থিসিস প্রকাশিত হয়।
এতক্ষণ তাঁকে কবি হিসেবে পরিচয় দিলাম। আসলে তিনি শুধুই কবি ছিলেন না। তিনি সমাজসেবী, রাজনীতিবিদ, প্রখ্যাত দার্শনিক আইনজ্ঞ প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি পাঞ্জাব আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩০ সালে নির্বাচিত হন মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে। ১৯৩১ ও ১৯৩২ সালে তিনি বিলেত গমন করেন ‘গোল টেবিল’ বৈঠকে যোগদানের জন্য। এই বৈঠকে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন দাবি দাওয়া পেশ করেন। অবশ্য এর আগে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে ১৯৩০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাই যে-পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান একটি রাষ্ট্রে পরিণত হউক। পৃথিবীর এই অংশে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে হোক বা বাইরে হউক-অন্ততপক্ষে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে একটি মুসলিম রাষ্ট্র সংগঠনই আমার মতে মুসলমানদের শেষ নিয়তি।’ এই মত অনুযায়ীই পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এ জন্য তাঁকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার বলা হয়। অবশ্য তিনি ১৯৩৭ সালের ২১শে জুন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি যেভাবে প্রস্তাব করছি সেভাবে পুনর্গঠিত মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের একটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্রই হল একমাত্র উপায়, যদ্বারা একটি শান্তিপূর্ণ ভারত গড়ে উঠতে পারে এবং সাথে সাথে অমুসলিম আধিপত্য থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে রক্ষা করা যেতে পারে। উত্তর পশ্চিম ভারত এবং বাংলার মুসলমানদেরকে কেন একটি স্বতন্ত্র জাতিরূপে স্বীকৃতি দেয়া হবে না-যাতে তারা ভারতের এবং ভারতের বাইরের অন্যান্য জাতিসমূহের ন্যায় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পেতে পারে?’ এ উদ্ধৃতিতে তিনি যে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্যও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলেছিলেন তা নিশ্চয় বুঝা যায়। মূলত আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ত্বও তাঁরই চিন্তার ফসল। অথচ এ মহান ব্যক্তিত্ত্বকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর হতে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হচ্ছে, একথা আগেই বলেছি। তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে যে কারণে তিনি নাকি পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। অথচ তিনি পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ারও বেশ আগে ১৯৩৮ সালের ২১শে এপৃল ইন্তিকাল করেন। আশা করি বুঝতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না যে, আমরা এ মহান ব্যক্তিত্ত্বকে অস্বীকার করে কি পরিমাণ মূর্খতায় ও ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। সত্যি কথা আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু অনুদার বুদ্ধিজীবি এর জন্য দায়ী।
উপমহাদেশের এ প্রখ্যাত দার্শনিক কবি অসম্ভব দেশপ্রেমিক একজন মানুষ ছিলেন। লেখার শুরুতেই যে কবিতাটির উদ্ধৃতি দিয়েছি তার কাব্যানুবাদ এ রকমের-
‘আরব আমার, ভারত আমার, চীনও আমার-
নহে তো পর-
মুসলিম আমি,- জাহান জুড়িয়া
ছড়ানো রয়েছে আমার ঘর।’
দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সচেতনভাবে এ কবিকে বর্জন করা হয়। তার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে জহুরুল হক নামকরণ করা, পাঠ্যতালিকা হতে তাঁর রচনা ও জীবনী বাদ দেয়া।
আমরা আশা করবো এখন হতে নতুন করে আবার আমরা ইকবাল চর্চায় ফিরে যাব। কবিকে তাঁর প্রকৃত সম্মানে সম্মানিত করবো। দেশের সব শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে তাঁর রচনা অন্তুর্ভুক্ত হওয়া এ জাতির কল্যাণের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন, সে দিকটা দেখার জন্য সরকারের প্রতি আহবান রইলো।

No comments:

Post a Comment