Tuesday, October 20, 2015

রাজপুত্তুর কবি

এই হিং নেবে হিং, কিসমিস, খুবানি, আঙুর, পেস্তা, বাদাম, আখরোটঃ নে-বে। লম্বা পিরহানের জেবে কলসী ভাঙা চাড়া, কড়ি এসব ভরে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তুলে দরাজ গলায় হেঁকে চলেছে এক কিশোর। বড় বড় উজ্জ্বল দুটি চোখ। যেন সে দুটি চোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ছে সত্যের দ্যুতি। লম্বা বাঁকানো বাঁশির মত নাক, প্রশস্ক কপাল, ঘাড় অবধি নেমে যাওয়া ঝাঁকড়া চুল-সব মিলিয়ে এক অপরূপ রাজপুত্তুর। কাবুলিওয়ালা সাজার ইচ্ছায় যে রাজপুত্তুর বেশ হাঁক-ডাক করতো।
রাজপুত্তুরটির যেমন ছিল দরাজ গলা, আগুনঝরা চোখ, বাবরীদোলানো চুল, তেমনি ছিল দুরন্ত সাহস। ভয় কখনো তাঁর দিলে বাসা বাঁধেনি। যা সত্য, যা সুন্দর তা সে আজীবনই মেনে চলেছে, সমাজেও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
তোমরা হয়ত ভাবছ, সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের কোন কথা বলছি। না, আসলে তা নয়। এর রাজপুত্তুরটি রাজমহল আমাদের দেশের এক গন্ডগ্রামে। অতীতকালে তাঁর এলাকাটা শাসন করেছে রাজা প্রতাপাদিত্য, রাজা বিক্রমাদিত্য, খান জাহান আলীর মত রাজা বাদশাহরা। হ্যাঁ, দেশটির নাম যশোরাদ্য দেশ। পরে এটা যশোর জেলা নামে পরিচিত হয়। এ জেলারই মাগুরা মহকুমার আওতাধীন মাঝাইল গ্রামে সে রাজমহল। রাজপুত্তুরটির নাম ফররুখ। পুরো নাম সৈয়দ ফররুখ আহমদ।
১৯১৮ সালের ১০ই জুন ফররুখ আহমদ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন এক জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। মায়ের নাম বেগম রওশন আখতার। মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান তিনি।
গ্রামের স্কুলেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর কলকাতার তালতলি মডেল স্কুলে, বালিগঞ্জ হাইস্কুলে, খুলনা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করেন। খুলনা জেলা স্কুল হতে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে পড়াকালে কবি গোলাম মোস্তফাকে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। আর খুলনা জেলা স্কুলে পান কবি আবুল হাশিম ও অধ্যাপক আবুল ফজলকে শিক্ষক হিসেবে। কলকাতার রিপন কলেজ হতে ১৯৩৯ সালে তিনি আইএ পাশ করেন। পরে দর্শনে অনার্স নিয়ে বিএ ভর্তি হন। আরো পরে ইংরেজিতে অনার্স নেন। ‍কিন্তু ঐ পর্য্ন্ত যে কোন কারণেই হোক তাঁর আর অনার্স পরীক্ষা দেওয়া হয় নি।
হ্যাঁ, রাজপুত্তুরটি ছিলেন সত্যি সত্যিই রাজপুত্তুরের মত। যখন হাঁটতেন মনে হত কেশর দুলিয়ে সিংহের বাচ্চা হেঁটে যাচ্ছে। হাঙর কুমিরকে থোড়াই কেয়ার করে দলবল নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনি বলতেন, ‘হাঙর কুমির যদি থাকে, আমার ভয়েই তারা পালিয়ে যাবে।’ সারা জীবন এমনই তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, কারো কাছে কোনদিন কোন কারণে মাথা নত করেন নি।
রাজপুত্তুরটি ছিলেন খুবই ভাবুক প্রকৃতির। রাতের বেলা যখন আকাশে চাঁদ হেসে উঠতো তখন বিছানা ছেড়ে চলে যেতেন ডাহুক ডাকা বাঁশঝাড়টার কাছে। চুপচাপ শুনতেন ডাহুকের ডাক আর কবিতা লিখেতেন-
রাত্রিভর ডাহুকের ডাক……
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধ দীঘি অতল সুপ্তির
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি
কানপেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
আবার-
          তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
          ক্রমাগত ভেসে আসে পালক মেঘের অন্তরালে
          অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
          স্বপ্নের প্রবাল।
মাঝে মাঝে তিনি বাড়ির পুচকে পুচকে পাইক বরকন্দাজ নিয়ে বেড়াতে বের হতেন্, যেন রাজপুত্তুরের হরিণ শিকার। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন মধুমতির তীরে। পলকহীনভাবে দেখতেন নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার জাহাজের আনাগোনা। শুনতেন মাঝি-মাল্লার দাঁড় ফেলার শব্দ, হাঁক-ডাক। এসব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যেতেন। সাথীদেরকে এসময় দিতেন ভূগোলের জ্ঞান। বলতেন, “পাহাড় হতে এসেছে এই নদী। তারপর চলে গেছে দক্ষিণে, সেখানে আছে বঙ্গোপসাগর, তারপর আরব সাগর। নৌকা চড়ে ভেসে যেতে কোনো বাধা নেই, কোনো মানা নেই। কিন্তু সাবধান, হুঁশিয়ার। আসবে ঝড়, উঠবে তুফান, বড় বড় কুমীর আর হাঙর মাতামাতি করবে। আল্লাহ আল্লাহ করে নৌকা ছাড়লে আর কোন ভয় নেই।”
কবি ফররুখ আহমদ চেয়েছিলেন এই ঘূনে ধরা সমাজটাকে ভেঙ্গে একটা সুন্দর সমাজ গড়তে।
তাঁর কথায়-
          আল্লাহর দেওয়া বিশ্ববিধান
          ইসলামী শরীয়ত
          যে বিধানে মোরা গড়িয়া তুলিব
          এই পাক হুকুমত।।
          তৌহিদে রাখিয়া দৃঢ় বিশ্বাস
          আমরা সৃজিব নয়া ইতিহাস
          দেবো আশ্বাস দুনিয়ার বুকে
          দেখাব নতুন পথ।।
          সারা ‍মুসলিম দুনিয়াকে বেঁধে
          একতার জিনজিরে
          ফিরায়ে আনাব হারানো সুদিন
          নয়া জামানার তীরে।।
          আলী, উসমান, উমরের দান
          নেব তুলে মোরা জেহাদী নিশান
          নেব ফেরা মোর আবূ বকরের
          সত্য সে খেলাফত।
কবির দৃঢ় বিশ্বাস আগের দিনে যারা জাতির নেতৃত্ব দিয়েছে, তাঁদের ত্রুটির কারণেই আজ মুসলিম জাতি এই খারাপ অবস্থায় পৌছেছে। যেমন-
              শুধু গাফলাতে, শুধু খেয়ালের ভুলে
              দরিয়া অথই ভ্রান্তি নিয়াছে তুলে
              আমাদেরই ভুলে পানির কিনারে,
              মুসাফির দল বসি,
              দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের,
              সেতারা শশী।
              মোদের খেলাধূলায় লুটায়ে পড়ি
              কেঁদেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্ববরী। (পাঞ্জেরী)।
সারা দুনিয়ায় আবার নতুন করে মুসলিম জাগরণ শুরু হয়েছে। আবার যেন নতুন সূর্য্ ওঠার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি লিখেছেন-
              কেটেছে রঙ্গিন মখমল দিন, নতুন
              সফর আজ,
              শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,……….
              …………………………………………
              নতুন পানিতে সফর এবার এ
              মাঝি সিন্দাবাদ। (সিন্দাবাদ)।
কিন্তু আমাদের জাতির নেতারা যখন হতাশ, সাহসহারা তখনো রাজপুত্তুর তার সাহসে ভর দিয়ে বলেছেন-
              আজকে তোমায় পাল ওঠাতেই হবে,
              ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
              ভাঙ্গা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
              তবুও জাহাজ আজ ওঠাতেই হবে। (সাত সাগরের মাঝি)।
কবির রাজপুত্তুরটি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এই দৃঢ় প্রত্যয়ী রাজপুত্তুরটি তার জীবনেও ইসলামী অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। কোন ঝড়, কোন বিপদ তাঁকে এপথ হতে চুল পরিমাণও সরাতে পারে নি।
তিনি বিপদ মুসিবতের সময় ভেঙ্গে পড়াকে ঘৃণা করতেন। এই সময় আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য চাওয়াটাও মোটেই পছন্দ করতেন না। কবি লিখেছেন-
          তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদার মদদ ছাড়া
পরের ওপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া।
এমনিভাবে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে দেশ জাতির মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি তোমাদের জন্য অনেক ভাল ভাল বই লিখেছেন। যেমন-‘পাখির বাসা’, ‘হরফের ছড়া’, ‘নতুন লেখা’, ‘ছড়ার আসর’, ‘নয়া জামাত’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি। ‘পাখির বাসা’ বইটির জন্য তিনি ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও কবি পেয়েছেন-বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার।

No comments:

Post a Comment