নাম আবদুল করীম। উপাধি সাহিত্য
বিশারদ ও সাহিত্য সাগর। আব্বার নাম মুনশী নুরুদ্দীন এবং দাদার নাম মোহাম্মদ
নবী চৌধুরী। আবদুল করীমের পুরো নাম মুনশী আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদ। তবে
তিনি আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদ নামেই পরিচিত। এমনকি শুধু সাহিত্য
বিশারদ বললেই তাঁকেই বুঝানো হয়। তিনি ছিলেন একাধারে সংগ্রাহক, গবেষক,
প্রবন্ধকার ও সম্পাদক। না, তিনি কবি বা মৌলিক কোন লেখক ছিলেন না। আর এ
জন্যেই অনেকের কাছে তিনি কিছুটা অপরিচিত। কিন্তু তাই বলে তিনি মোটেও ছোট
খাট কোনো ব্যক্তি নন। তিনি আমাদের বাঙলা সাহিত্য অঙ্গনের এক মহান মনীষী।
যাকে বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে। সত্যি কথা বলতে কি
পুরো বাঙ্গালি জাতি এই মহান মানুষটির কাছে ঋণী হয়ে আছেন।
সাহিত্য বিশারদ মুন্সি আবদুল করিম ১৮৬৯, মতান্তরে ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর পটিয়া মহকুমার সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত কাদির রাজার অধস্তন বংশধর। তাঁর উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ হাবিলাস মল্ল কোন এক সময় চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক দ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে ঐ দ্বীপের নামকরণ করা হয় হাবিলাস দ্বীপ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আবদুল করীম দুনিয়ার মুখ দেখার আগেই তাঁর পিতা মুনশী নুরউদ্দীন ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাতা মিস্রীজান প্রখ্যাত পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের মেয়ে ছিলেন।
জন্মের কয়েক মাস আগে পিতার মৃত্যু এবং ১৭
বছর বয়সে মাতৃহীন আবদুল করিম দাদা-দাদি ও চাচা-চাচির স্নেহছায়ায় এন্ট্রান্স
পাস করেন এবং সচেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ
করেন। তার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল বাড়ির দহলিজেই। সেখানেই তিনি আরবি-ফারসি ও
বাংলায় পড়া শুরু করেন। অতঃপর তিনি সুচক্রদণ্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি
হন। এক বছর পড়াশোনা করে তিনি পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান
থেকে ১৮৯৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য
যে, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তার দ্বিতীয় ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং সঙ্গত কারণেই
উনিশ শতকে এন্ট্রান্স পাস করতে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানেও পারদর্শী হতে হতো।
চট্টগ্রাম কলেজে দু’বছর এফএ পড়ার পর ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে
চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক সম্পন্ন পরিবারের মতো তাদের পরিবারেও অর্থনৈতিক
অসচ্ছলতা অনিবার্য করে তোলে। এর সঙ্গে যোগ হয় শারীরিক অসুস্থতা। পরীক্ষার
আগে তিনি টাইফয়েড এ আক্রান্ত হন। ফলে তার আর এফএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এখানেই তার উচ্চ শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
১৮৯৫ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের
শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবনের শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি সীতাকুণ্ড মধ্য
ইংরেজি স্কুলের অস্থায়ী প্রধান শিক হন। চট্টগ্রামে প্রথম সাব-জজ আদালতে
অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কাজ করেন। পরে কবি নবীন সেনের সুপারিশে চট্টগ্রাম
কমিশনার অফিসে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আজীবন প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সেবা করে গেছেন।
বাঙালি লেখকেরা যখন পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে ও অনুরাগে আধুনিক বাংলা
সাহিত্য সৃষ্টিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তখন
প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথির রণাবেণ এবং পুঁথি সম্পাদনায়
নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মূলত পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথির রণাবেণ ও পুঁথি সম্পাদন
ছিল তার জীবনের ব্রত। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান উপাদান
পুঁথি পত্র ও এদেশের প্রাচীন ও মধ্য যুগের লৌকজ-সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ
করেছেন। তাঁর সম্পাদিত নরোত্তম ঠাকুরের ‘রাধিকার মানভঙ্গ’, কবিবল্লভের
‘সত্যনারায়ণের পুথিঁ’, দ্বিজ রতিদেবের ‘মৃগলুব্ধ’ রামরাজার ‘মৃগলুব্ধ
সম্বাদ’, দ্বিজ মাধবের ‘গঙ্গামঙ্গল’, আলী রাজার ‘জ্ঞানসাগর’, বাসুদেব ঘোষের
‘শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’, মুক্তারাম সেনের ‘সারদামঙ্গল’, শেখ ফয়জুল্লাহর
‘গোরক্ষবিজয়’ ও আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (খণ্ডাংশ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে
প্রকাশিত। ‘ইসলামাবাদ’ (চট্টগ্রামের সচিত্র ইতিহাস) ও ‘আরাকান রাজসভায় বাঙ্গলা সাহিত্য’ (মুহম্মদ এনামুল হকের সহযোগে রচিত) তাঁর দুটি মৌলিক গ্রন্থ।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাল্যকাল থেকেই পুঁথিপত্রের প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন।
সারা জীবন তার নেশা ছিল দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাকি-মাসিক ইত্যাদি পত্রিকা পাঠ
করা এবং সংগ্রহ করা। তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁর পিতামহ কর্তৃক সংগৃহীত কিছু
পুঁথির সঙ্গে পরিচিত হন। এই পুঁথিগুলো পড়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহে ও এ নিয়ে
লিখতে আগ্রহী হন। এ পুঁথিগুলোর মধ্যেই পেয়ে যান ‘চণ্ডীদাসের পদাবলী’। সেসময়
তিনি ছিলেন এফএ ক্লাসের ছাত্র। এ সময় তিনি আচার্য অক্ষয় সরকার সম্পাদিত
‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘প্রাচীন পদাবলী’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ
পাঠ করেই মহাকবি নবীন চন্দ্রসেন সাহিত্যবিশারদের প্রতি আকৃষ্ট হন।
একান্ত শিশুকাল হতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত
আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদকে আমরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন পাঠক
সংগ্রাহক ও তথ্যনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে দেখতে পাই। এই মহান মনীষী ৩০ শে
সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে ৮৩ বছর বয়সে চট্টগ্রামে ইন্তিকাল করেন।
No comments:
Post a Comment