Tuesday, October 20, 2015

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ

উপমহাদেশের সাংবাদিকতা জগতের দিকপাল, মুসলিম গণজাগরণের নকীব, সুসাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজসেবী মোহাম্মদ আকরম খাঁ পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার হাকীমপুর গ্রামের এক বিখ্যাত পরিবারে ১৮৬৮ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর আগে এবং তাঁর সমসাময়িককালে উল্লেখযোগ্য অনেক মুসলমান খ্যাতিমান লেখক-সাংবাদিকগণ মাসিক, ত্রৈমাসিক, দৈনিক ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশ করলেও সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতা একটা দীর্ঘস্থায়ী ভীত রচনা করেন, তাঁর প্রকাশিত ‘দৈনিক আজাদ’ (১৯৩৬-১৯৯২) ও মাসিক ‘মোহাম্মদী’ বৃটিশ আমলে আত্মপ্রকাশ করে সুদীর্ঘকাল টিকে থাকে এবং পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও কিছুকাল এই পত্রিকা দু’টির অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। মুসলিম বাংলার নবজাগরণে, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে, সামাজিক সংস্কারে, লেখক সৃষ্টিতে ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এবং ১৯৮৪ ও ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে দৈনিক আজাদ ও মাসিক মোহাম্মদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিশুকালে পিতা-মাতাকে হারানোর পর আত্মীয়ের তত্ত্ববধানে তিনি বেড়ে ওঠেন। অতপর তিনি লালিত আত্মীয়-স্বজনের প্রচেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর খুব বেশি ছিল না। তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জটিল পরিস্থিতিই ১৯০০ সালে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে এফএম পাস করেন।
কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করার পর মওলানা আকরম খাঁ কর্মজীবনে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেচে নিন। খুব অল্প বয়সেই আহলে হাদীস ও মোহাম্মদী আকবর পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা পেশায় হাতেখড়ি হয়।
আহলে হাদীস ও মোহাম্মদী আকবর পত্রিকায় সাংবাদিকাতার মাধ্যমে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করার পর মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ১৯০৮ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত দি মোহাম্মদী ও আল-ইহসান পত্রিকার স¤পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ১৯২০ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সময়ে কলকাতা থেকে জামানা ও সেবক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৩৬ সালের ৩১শে অক্টোবর তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং এটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪০ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে এর সম্পদনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি অবসর জীবনে চলে যান।
মওলানা আকরাম খাঁ সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, ধর্মশাস্ত্রবেত্তা, সুপ-িত ব্যক্তি এবং শক্তিশালি গদ্যলেখক হিসেবে খ্যাতিমান। বাংলার মুসলমান সমাজের নবজাগরণ তথা রেনেসাঁর তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। মওলানা আকরাম খাঁ রচিত গ্রন্থাদি, বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় রচনা একজন সুপ-িত ব্যক্তি, চিন্তাশীল ও মননশীল লেখক এবং শক্তিমান গদ্যশিল্পীকেই চিনিয়ে দেয়। বিভিন্ন সময়ে তাঁর একাধিক প্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যা পাঠক শ্রেণী ও বোদ্ধামহলে বেশ প্রশংসিত ও খ্যাত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যকয়েকটি হল,-
*** আমপারার বাংলা অনুবাদ
*** মোস্তফা-চরিত
*** মোস্তফা-চরিতের বৈশিষ্ট্য
*** বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম
*** মুসলীম বাংলার সামাজিক ইতিহাস
*** তাফসীরুল কোরআন (১-৫ খন্ড, অনুবাদ)
*** টীকা-ভাষ্য (অনুবাদ)
মৌলিক রচনা ছাড়াও তাঁর বাংলায় অনুদীত গ্রন্থগুলো প্রমাণ করে তিনি যে একজন দক্ষ অনুবাদক এবং সুপ-িত ব্যাক্তি।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতি শুরু করেন। মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি এবং মওলানা মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আকরাম খাঁর দায়িত্ব ছিল তুর্কি খেলাফত থেকে ফান্ড সংগ্রহ করা। ১৯২০-১৯২৩ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে জনসভা বা সম্মেলনের আয়োজন করে খেলাফত আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন গতিশীল করার চেষ্ঠা করেন।
১৯৪১ সালে তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং একনাগাড়ে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ও পরে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালে গণপরিষদ ভেঙ্গে গেল তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি হতে দূরে সরে যান এবং ১৯৬২ সালে আজাদের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মোহাম্মদ আকরম খাঁ মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিদাতসমূহের চরম বিরোধী ছিলেন। তিনি ব্যক্তি পূজা, কবর পূজা ও অন্যান্য প্রচলিত রসম রেওয়াজের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ধারণ করেছিলেন।
তিনি ১৯৪৭ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ১০১ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালের ১৮ আগষ্ট রাজধানী বংশালে আহলে হাদীস মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

No comments:

Post a Comment