দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। দুজন মানুষ তার চেয়েও দ্রুত এগিয়ে চলছিলেন। ওই
আঁধার নামার আগেই তাদের পৌঁছাতে হবে ডেলফিতে। একজনের নাম চেরেফোন (Chaerephon) মধ্যবয়সী গ্রিক।
দুজনে এসে থামলেন ডেলফির বিরাট মন্দির প্রাঙ্গণে। সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে
প্রবেশ করতেই মন্দিরের পূজারি এগিয়ে এলো। চেরেফোন তার দিকে চেয়ে বললেন,
আমরা দেবতার কাছে একটি বিষয় জানার জন্য এসেছি। পূজারি বলল, আপনারা প্রভু
অ্যাপলের মূর্তির সামনে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিন আর বলুন আপনারা কী জানতে
চান?
কুৎসিত চেহারার মানুষটি প্রথমে এগিয়ে এসে বললেন, আমি সক্রেটিস, প্রভু,
আমি কিছুই জানি না। এবার চেরেফোন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, হে সর্বশক্তিমান
দেবতা, আপনি বলুন গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী কে?
চেরেফোনের কথা শেষ হতেই চারদিক কাঁপিয়ে আকাশ থেকে এক দৈববাণী ভেসে এলো।
যে নিজেকে জানেন সেই সক্রেটিসের জন্ম (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬৯/৪৬৩) পিতা সফরেনিকাশ (Sopphroniscus) ছিলেন স্থপতি। পাথরের নানা মূর্তি গড়তেন মা ফেনআরেট (Sopphroniscus)। ছিলেন ধাত্রী।
পিতা-মাতা দুজনে দুই পেশায় নিযুক্ত থাকলেও সংসারে অভাব লেগেই থাকত। তাই
ছেলেবেলায় পড়াশোনার পরিবর্তে পাথর কাটার কাজ নিতে হলো। কিন্তু অদম্য
জ্ঞানসপৃহা সক্রেটিসের। যখন যেখানে যেটুকু জানার সুযোগ পান সেটুকু জ্ঞান
সঞ্চয় করেন। এমনি করেই বেশ কয়েক বছর কেটে গেল।
একদিন ঘটনাচক্রে পরিচয় হলো এক ধনী ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি সক্রেটিসের ভদ্র
ও মধুর আচরণে, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর পড়াশোনার দায়িত্ব
নিলেন।
পাথরের কাজ ছেড়ে সক্রেটিস ভর্তি হলেন এনাক্সগোরাস (Anaxagoras) নামের এক গুরুর কাছে। কিছুদিন পর কোনো কারণে এনাক্সগোরাস আদালতে অভিযুক্ত হলে সক্রেটিস আরখ এখলাসের শিষ্য হলেন।
এই সময় গ্রিস দেশ ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ফলে নিজেদের মধ্যে
মারামারি, যুদ্ধবিগ্রহ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। দেশের প্রতিটি তরুণ,
যুবক, সক্ষম পুরুষদের যুদ্ধে যেতে হতো।
সক্রেটিসকেও এথেন্সের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে অ্যামপিপোলিস অভিযানে যেতে হলো। এই যুদ্ধের পর তার মন ক্রমশই যুদ্ধের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠল।
চিরদিনের মতো সৈনিকবৃত্তি পরিত্যাগ করে ফিরে এলেন এথেন্সে। এথেন্স তখন
জ্ঞান-গরিমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শৌর্য, বীর্যে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ।
শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির এক স্বর্ণযুগ।
এই পরিবেশে নিজেকে জ্ঞানের জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না
সক্রেটিস। তিনি ঠিক করলেন জ্ঞানের চর্চায়, বিশ্ব প্রকৃতি জানার সাধনায়
নিজেকে উৎসর্গ করবেন।
প্রতিদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সামান্য প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়তেন।
খালি পা, গায়ে একটা মোটা কাপড় জড়ানো থাকত। কোনোদিন গিয়ে বসতেন নগরের কোনো
দোকানে, মন্দিরের চাতালে কিংবা বন্ধুর বাড়িতে। নগরের যেখানেই লোকজনের ভিড়
সেখানেই খুঁজে পাওয়া যেত সক্রেটিসকে। প্রাণ খুলে লোকজনের সঙ্গে গল্প করছেন।
আড্ডা দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন, নিজে এমন ভাব দেখাতেন যেন কিছুই
জানেন না, বোঝেন না। লোকের কাছ থেকে জানার জন্য প্রশ্ন করছেন।
আসলে প্রশ্ন করা, তর্ক করা ছিল সে যুগের এক শ্রেণীর লোকদের ব্যবসা। এদের বলা হতো সোফিস্ট। এরা পয়সা নিয়ে বড় বড় কথা বলত।
যারা নিজেদের পাণ্ডিত্যের অহংকার করত, বীরত্বের বড়াই করত, তিনি সরাসরি
জিজ্ঞেস করতেন, বীরত্ব বলতে তারা কী বোঝে? পাণ্ডিত্যের স্বরূপ কী? তারা যখন
কোনো কিছু উত্তর দিত, তিনি আবার প্রশ্ন করতেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন সাজিয়ে
বুঝিয়ে দিতেন তাদের ধারণা কত ভ্রান্ত। মিথ্যা অহমিকায় কতখানি ভরপুর হয়ে আছে
তারা। নিজেদের স্বরূপ এভাবে উদঘাটিত হয়ে পড়ায় সক্রেটিসের ওপর তারা সকলে
ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। কিন্তু সক্রেটিস তাতে সামান্যতম বিচলিত হতেন না। নিজের
আদর্শ, সত্যের প্রতি তার ছিল অবিচল আস্থা। সেই সাথে ছিল অর্থ সম্পদের প্রতি
চরম উদাসীনতা।
একবার তার বন্ধু অ্যালসিবিয়াদেশ তাকে বাসস্থান তৈরি করার জন্য বিরাট
একখণ্ড জমি দিতে চাইলেন। সক্রেটিস বন্ধুর দান ফিরিয়ে দিয়ে সকৌতুকে বললেন,
আমার প্রয়োজন একটি জুতার আর তুমি দিচ্ছ একটি বিরাট চামড়া এ নিয়ে আমি কী করব
জানি না।
পার্থিব সম্পদের প্রতি নিসপৃহতা তার দার্শনিক জীবনে যতখানি শান্তি নিয়ে
এসেছিল, তার সাংসারিক জীবনে ততখানি অশান্তি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার প্রতিও
তিনি ছিলেন সমান নিসপৃহ।
তার স্ত্রী জ্ঞ্যানথিপি (Xanthiphe) ছিলেন ভয়ংকর রাগী
মহিলা। সাংসারিক ব্যাপারে সক্রেটিসের উদাসীনতা তিনি মেনে নিতে পারতেন না।
একদিন সক্রেটস গভীর একাগ্রতার সাথে একখানি বই পড়ছিলেন। প্রচণ্ড বিরক্তিতে
জ্ঞ্যানথিপি গালিগালাজ শুরু করে দিলেন। কিছুক্ষণ সক্রেটিস স্ত্রীর
বাক্যবাণে কর্ণপাত করলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রক্ষা করতে না
পেরে বাইরে গিয়ে আবার বইটি পড়তে আরম্ভ করলেন। জ্ঞ্যানথিপি আর সহ্য করতে না
পেরে এক বালতি পানি এনে তার মাথায় ঢেলে দিলেন। সক্রেটিস মৃদু হেসে বললেন,
আমি আগেই জানতাম যখন এত মেঘগর্জন হচ্ছে তখন শেষ পর্যন্ত একপশলা বৃষ্টি
হবেই।
জ্ঞ্যানথিপি ছাড়াও সক্রেটিসের আরো একজন স্ত্রী ছিলেন, তার নাম মায়ার্ত (Myrto)।
দুই স্ত্রীর গর্ভে তার তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। দারিদ্র্যের
মধ্যে হলেও তিনি তাদের ভরণ পোষণ শিক্ষার ব্যাপারে কোনো উদাসীনতা দেখাননি।
তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিক্ষার মধ্যেই
মানুষের অন্তরের জ্ঞানের পূর্ণ জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। জ্ঞানের মধ্যে
দিয়েই মানুষ একমাত্র সত্যকে চিনতে পারে। যখন তার কাছে সত্যের স্বরূপ
উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সে আর কোনো পাপ করে না। অজ্ঞানতা থেকেই সমস্ত পাপের জন্ম।
তিনি চাইতেন মানুষের মনের সেই অজ্ঞানতাকে দূর করে তার মধ্য বিচার বৃদ্ধি
বোধকে জাগ্রত করতে। যাতে তারা সঠিকভাবে নিজেদের কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করতে
পারে।
তার লক্ষ্য ছিল আলোচনা জিজ্ঞাসা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সেই সত্যকে উপলব্ধি করতে মানুষকে সাহায্য করা।
কথার মধ্য দিয়ে তর্ক বিচারের পদ্ধতিকে দার্শনিকরা আস্তি নাস্তিমূলক পদ্ধতি (Dialectic Methood)
নাম দিয়েছেন, সক্রেটিস এই পদ্ধতির সূত্রপাত করেছিলেন। পরবর্তীকালের তার
শিষ্য প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল সেই ধারাকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত
করেছিলেন ন্যায় শাস্ত্রে।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষ ভাগ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত
গ্রিক সভ্যতার স্বর্ণযুগ। এই যুগেই সক্রেটিসের জন্ম। কিন্তু তার যৌবনকাল
থেকে এই সভ্যতার অবক্ষয় শুরু হলো। পরসপরের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের ফলে
প্রত্যেকেরই প্রভাব-প্রতিপত্তি কমতে আরম্ভ করল। গ্রিসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ
রাষ্ট্র এথেন্সও তার প্রভাব থেকে বাদ পড়ল না। শুধু অর্থনীতি নয়, সমাজ
রাজনীতিতেও নেমে এলো বিপর্যয়। তর্কের মধ্যে দিয়ে আলোচনার পথ ধরে মানুষের
মধ্যে চিন্তার উন্মেষ ঘটানো, সত্যের পথে মানুষকে চালিত করা।
সক্রেটিসের আদর্শকে দেশের বেশ কিছু মানুষ সুনজরে দেখেনি। তারা
সক্রেটিসের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা করল। তাছাড়া যারা ঐশ্বর্য, বীরত্ব
শিক্ষার অহংকারে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত, সক্রেটিসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
তাদের এই অহংকারের খোলসটা খসে পড়ত। এভাবে নিজেদের স্বরূপ উদঘাটিত হয়ে পড়ায়
অভিজাত শ্রেণীর মানুষরা সক্রেটিসের ঘোর বিরোধী হয়ে উঠল। তাদের চক্রান্তে
দেশের নাগরিক আদালতে সক্রেটিসের ঘোর বিরোধী অভিযোগ আনা হলো (৩৯৯
খ্রিষ্টপূর্ব)।
তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল তিনি এথেন্সের প্রচলিত দেবতাদের
অস্তিত্ব অস্বীকার করে নতুন দেবতার প্রবর্তন করতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত তিনি
দেশের যুবসমাজকে ভ্রান্ত পথে চালিত করেছেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আরো দুটি কারণ ছিল সপার্টার সঙ্গে ২৭ বছরের
যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয়ের ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট আঘাত এলো।
অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিল। সেকালের ধর্মবিশ্বাসী মানুষরা মনে করল নিশ্চয়ই
দেবতাদের অভিশাপেই এই পরাজয় আর এর জন্য দায়ী সক্রেটিসের ঈশ্বরবিদ্বেষী
শিক্ষা।
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে এলো মেলেতুল, লাইকন, আনাতুস নামে এথেন্সের
তিনজন সমভ্রান্ত নাগরিক। এই অভিযোগের বিচার করার জন্য আলোচোনের সভাপতিত্বে
৫০১ জনের বিচারকমণ্ডলী গঠিত হলো। এই বিচারকমণ্ডলীর সামনে সক্রেটিস এক
দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার বিরোধীপক্ষ কী বলেছিল তা জানা যায়নি। তবে
সক্রেটিসের জবানবন্দি লিখে রেখে গিয়েছিলেন প্লেটো। এক আশ্চর্য সুন্দর
বর্ণনায়, বক্তব্যের গভীরতায় এই রচনা বিশ্ব সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
…হে এথেন্সের অধিবাসীগণ, আমার অভিযোগকারীদের বক্তৃতা শুনে আপনাদের কেমন
লেগেছে জানি না, তবে আমি তাদের বক্তৃতার চমকে আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম, যদিও
তাদের বক্তৃতায় সত্য ভাষণের চিহ্নমাত্র নেই। এর উত্তরে আমার বক্তব্য পেশ
করছি। আমি অভিযোগকারীদের মতো মার্জিত ভাষার ব্যবহার জানি না। আমাকে শুধু
ন্যায়বিচারের স্বার্থে সত্য প্রকাশ করতে দেয়া হোক।
কেন আমি আমার দেশবাসীর বিরাগভাজন হলাম? অনেক দিন আগে ডেলফির মন্দিরে
দৈববাণী শুনলাম তখনই আমার মনে হলো এর অর্থ কী? আমি তো জ্ঞানী নই তবে দেবী
কেন আমাকে দেবীর কাছে নিয়ে গিয়ে বলল এই দেখ আমার চেয়ে জ্ঞানী মানুষ।
আমি জ্ঞানী মানুষ খুঁজতে আরম্ভ করলাম। ঠিক একই জিনিস লক্ষ করলাম। সেখান
থেকে গেলাম কবিদের কাছে। তাদের সাথে কথা বলে বুঝলাম তারা প্রকৃতই অজ্ঞ।
তারা ঈশ্বরদত্ত শক্তি ও প্রেরণা থেকেই সবকিছু সৃষ্টি করেন, জ্ঞান থেকে নয়।
শেষ পর্যন্ত গেলাম শিল্পী, কারিগরদের কাছে। তারা এমন অনেক বিষয় জানেন যা
আমি জানি না। কিন্তু তারাও কবিদের মতো সব ব্যাপারেই নিজেদের চরম জ্ঞানী
বলে মনে করত আর এই ভ্রান্তিই তাদের প্রকৃত জ্ঞানকে ঢেকে রেখেছিল।
এই অনুসন্ধানের জন্য আমার অনেক শত্রু সৃষ্টি হলো। লোকে আমার নামে অপবাদ
দিল, আমিই নাকি একমাত্র জ্ঞানী কিন্তু ততদিনে আমি দৈববাণীর অর্থ উপলব্ধি
করতে পেরেছি। মানুষের জ্ঞান কত অকিঞ্চিৎকর। দেবতা আমার নামটা
দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্যবহার করে বলতে চেয়েছিলেন তোমাদের মধ্যে সেই সর্বাপেক্ষা
জ্ঞানী যে সক্রেটিসের মতো জানে, যে সত্য সত্যই জানে আর জ্ঞানের কোনো মূল্য
নেই।
আমি নিশ্চিত যে আমি অনেকের অপ্রিয়তা এবং শত্রুতা অর্জন করেছি এবং আমার
চরম দণ্ড হলে এই শত্রুতার জন্যই হবে, মেলেতুস বা আনিতুসের জন্য নয়। দণ্ড
হলে তা হবে জনতার ঈর্ষা ও সন্দেহের জন্য যা আমার আগে অনেক সৎকারের নিধনের
কারণ হয়েছে এবং সম্ভবত আরো অনেকের নিধনের কারণ হবে। আমিই যে তাদের শেষ বলি
তা মনে করার কোনো কারণ নেই…অতএব হে এথেন্সের নাগরিকগণ, আমি বলি তোমরা হয়
আনিতুসের কথা শোন অথবা অগ্রাহ্য কর। হয় আমাকে মুক্তি দাও নয়তো দিও না,
কিন্তু নিশ্চিত থাকতে পার আমি আমার জীবনের ধারা বদলাব না।
…আমাকে ঈশ্বর এই রাষ্ট্র আক্রমণ করতে পাঠিয়েছেন। রাষ্ট্র হলো একটি মহৎ
সুন্দর ঘোড়া। তার বৃহৎ আয়তনের জন্য সে শ্লথগতি এবং তার গতি দ্রুততর করতে,
তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য মৌমাছির প্রয়োজন ছিল। আমি মনে করি যে আমি ঈশ্বর
প্রেরিত সেই মৌমাছি। আমি সর্বক্ষণ তোমাদের দেহে হুল ফুটিয়ে তোমাদের মধ্যে
সুস্থ ভাবনা জাগিয়ে তুলি, যুক্তির দ্বারা উদ্বুদ্ধ করি এবং প্রত্যেককে
তিরস্কারের দ্বারা তৎপর করে রাখি।
…বন্ধুগণ সম্ভব অসম্ভবের কথা বাদ দিয়ে বলছি মুক্তিলাভের জন্য বা দণ্ড
এড়ানোর জন্য বিচারকদের অনুনয় করা অসঙ্গত। যুক্তি পেশ করে তাদের মনে প্রত্যয়
জন্মানোই আমাদের কর্তব্য, বিচারকের কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়বিচার করা। বিচারের
নামে বন্ধু তোষণ করা নয়।
…আমি দেবতাকে বিশ্বাস করি, আমার অভিযোগকারীরা যতখানি বিশ্বাস করে তার
চেয়েও অনেক বেশি বিশ্বাস করি। এতক্ষণ আমি ঈশ্বর এবং তোমাদের সামনে আমার
বক্তব্য রাখলাম। এবার তোমাদের এবং আমার পক্ষে যা সর্বোত্তম সেই বিচার হোক।
কিন্তু বিচারে ২৮১-২২০ ভোটে সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। সেই যুগে
এথেন্সে কোনো অভিযুক্তকে দোষী ঘোষণা করা হলে তাকে দুটি শাস্তির মধ্যে যে
কোনো একটিকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হতো।
কিন্তু সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন তিনি নির্দোষ, তাই রায় ঘোষিত হওয়ার পর
তিনি উত্তর দিলেন, হে এথেন্সের অধিবাসীগণ, আমার পক্ষ থেকে কি পাল্টা দণ্ড
প্রস্তাব করব? আমার যা ন্যায়ত প্রাপ্য তাই নয় কি? আমি তোমাদের প্রত্যেকের
কাছে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছি, সে শুধু তোমাদের কল্যাণের জন্য। এভাবে আমি
তোমাদের উপকার করতে চেয়েছি। উপকারীকে সরকারি ব্যয় ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করা
হোক এই আমার শেষ ইচ্ছা।
সক্রেটিসের এই বক্তব্যে জুরিরা আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। তাদের ধারণা হলো
সক্রেটিস তাদের ব্যঙ্গ করছেন। আরো অনেকে তার বিরুদ্ধে চলে গেল এবং বিচারে
তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো।
সেই ভয়ঙ্কর রায় শুনে এতটুকু বিচলিত হলেন না সক্রেটিস। স্থির শান্তভাবে
বললেন, এখন সময় হয়েছে আমাদের সকলকে চলে যাওয়ার, তবে আমি যাব মৃত্যুর দিকে,
তোমরা যাবে জীবনের দিকে। জীবন কিংবা মৃত্যু-একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন এর
মাঝে শ্রেষ্ঠ কে?
সক্রেটিসের বন্ধুদের মধ্যে ক্রিটো ছিলেন সবচেয়ে ধনী। তিনি কারারক্ষীদের
ঘুষ দিয়ে সক্রেটিসকে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু সক্রেটিস
বিশ্বাস করতেন দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই দেশের আইনশৃঙ্খলা মেনে চলা
কর্তব্য। বিচারালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার অর্থ আইনের
প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। তাছাড়া এতে সকলের মনে এই ধারণা হবে যে
সক্রেটিস সত্যি সত্যিই অপরাধী। তাকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচারকরা ঠিক কাজই
করেছেন।
মৃত্যুর দিন সকল শিষ্য একে একে উপস্থিত হলেন কারাগারে।
তিনি গোসল করে ফিরে এলেন। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। মুহূর্তে
মৃত্যুদূতের মতো দ্বারে এসে দাঁড়াল জেলের কর্মচারী। গভীর বেদনায় কাঁদতে
কাঁদতে ঘোষণা করল সক্রেটিসের বিষপানের সময় হয়েছে।
ক্রিটো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজকর্মচারীর দিকে ইঙ্গিত করতেই জল্লাদ কক্ষে
প্রবেশ করল, হাতে তার বিষের পাত্র। সক্রেটিস হাসিমুখে সেই পাত্র নিজের
হাতে তুলে নিলেন। অকল্পিতভাবে শেষবারের মতো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন
তারপরই সমস্ত বিষ পান করলেন।
তারপর জল্লাদের নির্দেশে ঘরের মধ্যে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। ধীরে ধীরে বিষ
তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পা দুটো ভারী হয়ে এলো। চলৎশক্তিহীন হয়ে
বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কাপড়ে মুখ ঢেকে দিলেন। কয়েক মুহূর্ত সব শান্ত। মৃত্যুর
সব শান্ত। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সক্রেটিস যাত্রা করলেন অমৃতলোকে।
তার মৃত্যুর পরেই এথেন্সের মানুষ ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ল। চারদিকে
ধিক্কার ধ্বনি উঠল। বিচারকদের দল সর্বত্র একঘরে হয়ে পড়ল। অনেকে অনুশোচনায়
আত্মহত্যা করলেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে মেনেতুসকে পিটিয়ে মারা হলো, অন্যদেশ
থেকে বিতাড়িত করা হলো। দেশের লোকেরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিরাট মূর্তি
প্রতিষ্ঠা করল।
প্রকৃতপক্ষে সক্রেটিসই পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক, চিন্তাবিদ যাকে তার
চিন্তা দর্শনের জন্য মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার
নশ্বর দেহের শেষ হলেও চিন্তার শেষ হয়নি। তার শিষ্য প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য
অ্যারিস্টটলের মধ্য দিয়ে সেই চিন্তার এক নতুন জগৎ সৃষ্টি হলো, যা মানুষকে
উত্তেজিত করেছে আজকের পৃথিবীতে।
No comments:
Post a Comment