ভারত উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশে যে
সমস্ত ওলীয়ে কামেল ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেছেন এবং ইসলাম প্রচারের
ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে হযরত উলূঘ খান জাহান(র.) নিঃসন্দেহে
উল্লেখযোগ্য। এ মহান মনীষীর সাথে যে সমস্ত শিষ্যগণ ছিলেন তাঁরাও স্ব স্ব
মহিমায় খ্যাতিমান হয়ে আছেন। কিন্তু এই বাংলার সন্তান একেবারে খাস বাঙালী
কোন শিষ্য, হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (র.) এর মত যশস্বী হতে পারেন নি।
আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে মুহাম্মদ তাহির জন্মগ্রহণ করেন। এ সম্বন্ধে নীলকান্ত বলেছেন-
‘পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস
যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হইলো সর্বনাশ।’
তাঁর পূর্ব নাম ছিল গোবিন্দ ঠাকুর।
অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্র তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে তাঁকে খাট চোখে দেখার
প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘তাঁহার পূবে কি নাম ছিল জানিনা, জানিয়াও
কোন কাজ নেই। এখন তাঁহার নাম তাহির।(যশোহর খুলনার ইতিহাস. ১ম খন্ড ৩৩৩
পৃষ্ঠা, শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র)। অবশ্য এ.এফ.এম. আবদুল জলীল সাহেব এ
সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বহুদিন অনুসন্ধানের পর জানিতে পারিয়াছি যে, এই ব্রাহ্মণ
সন্তানের পূর্ব নাম ছিল গোবিন্দলাল রায়। তিনি গোবিন্দ ঠাকুর নামেই পরিচিত
ছিলেন। ইনি খান জাহানের বিশেষ প্রিয় পাত্র ও আমত্য ছিলেন।’(সুন্দরবনের
ইতিহাস, ২য় খন্ড, ১১৮ পৃষ্ঠা-এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)। তিনি হযরত উলুঘ খান
জাহান আলী(র.) এর পরশে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং প্রধান সহচরে পরিণত হন। হযরত
উলুঘ খান জাহান আলীর এ দেশীয় শিষ্যদের মধ্যে হযরত পীর অলী মুহাম্মদ তাহিরই
সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও জননন্দিত ছিলেন। তাঁর হাতে হাজার হাজার অমুসলিম ইসলাম
ধর্মে দীক্ষা নেন। এই নবদীক্ষিত মুসলমারা পীরেলি নামে পরিচিত হন।
পীরেলি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি সম্বন্ধে এ.
এফ. এম. আবদুল জলীল সাহেব লিখেছেন, ‘পয়গ্রাম কসবায় বিখ্যাত পীর অলি
সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়। যশোহর অঞ্চলের একজন ব্রাহ্মণ খান জাহানের শিষ্যত্ব
গ্রহণ করিয়া ইসলাম কবুল করেন। তাঁহার নাম মুহাম্মদ তাহের। এই ব্রাহ্মণ
সন্তানের পূর্ব পরিচয় অস্পষ্ট। সতীশ বাবু তাহার সম্বন্ধে লিখেছেন,
‘ব্রাহ্মণ পরহিংসা করিতে গিয়ো আত্মহিংসাই করিয়াছেন। কারণ তিনি ধর্ম বা
রাজ্য লাভে অথবা সংস্পর্শ দোষে নিজের জাতি ধর্ম বিসর্জন দিয়ে ইসলাম ধর্মে
দীক্ষিত হয়েছিলেন।’(সুন্দরবনের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড ৩৩২, এ.এফ.এম আবদুল
জলীল)। এ. এফ. এম. আবদুল জলীল অন্যত্র লিখেছেন-‘খুলনা জেলার দক্ষিণ ডিহি
প্রাচীন হিন্দু প্রধান। সেনহাটি, মুলঘর কালিয়া প্রভৃতি স্থানের বহুপূর্বে
এখানে উচ্চশ্রেণীর বসবাস ছিল। এই গ্রামের নাম ছিল পয়োগ্রাম, এখনও এ নাম
আছে। এখানকার রায় চৌধুরী বংশের তৎকালে বিশেষ খ্যাতি ছিল। সম্ভবতঃ তুর্ক
আফগান আমলের প্রথম দিকে এ ব্রাহ্মণ বংশ রাজ সরকার হইতে সম্মানসূচক রায়
চৌধুরী উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ইহারা কনোজাগত ব্রাহ্মণ। ইহাদের পূর্ব
পুরুষ গুড় গ্রামের অধিবাসী বলিয়া ইহার গুড়ি বা গুড়গাঞী ব্রাহ্মণ হিসেবে
পরিচিত। এই বংশের কৃতি সন্তান দক্ষিণা নারায়ণ ও নাগরা নাথ। কথিত আছে যে
দক্ষিণা নারায়ণ দক্ষিণ ডিহি এবং নাগর উত্তর ডিহির সম্পত্তি ভাগ করিয়া
লইয়াছিলেন।
দক্ষিণ ডিহি নামের সহিত দক্ষিণা নারায়ণের
সম্পর্ক আছে বলিয়া অনেকে মনে করেন। নাগর বেজের ডাঙ্গায় একটি হাট
বসাইয়াছিলেন। উহার নাগরের হাট নামে পরিচিত ছিল। খান জাহানের আমলে চৌধুরীগণ
সমাজে সম্মানিত ছিলেন। নাগর নিঃসন্তান। ভ্রাতা দক্ষিণা নারায়ণের চারিপুত্র
ছিল। তাহাদের নাম যথাক্রমে কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। কামদেব ও জয়দেব
এই নবগত শাসনকর্তার অধীনে উচ্চপদ গ্রহণ করেন। কথিত আছে যে, মোহাম্মদ
তাহেরের চেষ্টায় তাহারা ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং এই ঘটনাই ইতিহাসে
পীরালিদের উৎপত্তি বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। (সুন্দরবনের ইতিহাস, দ্বিতীয়
খন্ড ৩৩২, এ.এফ.এম আবদুল জলীল)।
এ সম্পর্কে মি. ওমালি বলেন, ‘খান জাহান
একদা রোজার সময় ফুলের ঘ্রাণ নিতে থাকেন। ইহাতে তদীয় হিন্দু কর্মচারী
মোহাম্মদ তাহের (তখনও ইসলাম গ্রহণ করেন নি) বলেন যে, ‘ঘ্রাণেন কার্ধ বোজনং’
অর্থাৎ ঘ্রাণে অর্ধভোজন। খান জাহান পরে একদিন খানাপিনার আয়োজন করেন।
মাংসের গন্ধে তাহার নাকে কাপড় দিলে খান জাহান বলেন, যখন ঘ্রাণে অর্ধভোজন
তখন এই খানা ভক্ষণের পর আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন। তদনুসারে তাহের ইসলাম গ্রহণ
করেন। কথিত আছে যে, তাহেরের ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যে পুত্র সন্তান ছিলেন
তিনি হিন্দু থাকিয়া যান। তিনিই সর্বপ্রথম হিন্দু পীরালি এবং তাহেরকে লোকে
উপহাসচ্ছলে পীরালি বলত। তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া এদেশে পীরালি গান এবং বহু
কাহিনী রচিত হয়। ঐকান্তিক ধর্ম নিষ্ঠার জন্য শেষ পর্যন্ত তাহের পীরালি
আখ্যা পান।”(সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৩/৩৩৪ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল
জলীল)।
অন্য এক বর্ণনা মতে “মোহাম্মদ তাহেরের
সঙ্গে জয়দেব ও কাবদেব এর অন্তরের মিল ছিল না। তাহের মনে মনে তাঁহাদিগকে
মুসলমান করার চেষ্টা করিতেন। এ সম্পর্কে এতদঞ্চলে একটি গল্প প্রচলিত আছে,
তাহা কতটুকু সত্য তাহা জানি না। গল্পটি বর্ণনা করিতেছি-একদিন রমজানের সময়
তাহের রোজা রাখিয়াছেন। দরবার গৃহে জয়দেব ও কামদেব অন্যান্য কর্মচারীসহ
বসিয়া আছেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁহার বাটি হইতে একটি সুগন্ধী নেবু আনিয়া
তাহাকে উপহার দেন। পীরআলী নেবুর ঘ্রাণ লইতেছিলেন। এমন সময় কামদেব বলিলেন
হুজুর, ঘ্রাণে অর্ধভোজন-আপনি গন্ধ শুকিয়া রোজা ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন? এ কথার পর
পীরআলী ব্রাহ্মণের প্রতি চটিয়া যান। গোপনে পরামর্শ করিয়া স্থির হইল যে,
একদিন তিনি সমস্ত কর্মচারীদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আহার করাইবেন। নির্ধারিত
দিনে কামদেব ও জয়দেব সভাস্থলে উপস্থিত হইলেন। সভাগৃহের প্রাঙ্গনে গো-মাংসের
সহিত নানারকম মশলা দিয়া রন্ধনকার্য্ ধুমধামের সহিত চলিল। রান্নার গন্ধে
সভাগৃহ ভরপুর। জয়দেব ও কামদেব নাকে কাপড় দিয়া প্রতিরোধ করিতেছিলেন। পীরআলী
নাকে কাপড় কেন জিজ্ঞাসা করিলে কামদের মাংস রন্ধনের কথা উল্লেখ করেন। পীরআলী
নেবুর গল্প উল্লেখ করিয়া বলেন-‘এখানে গো-মাংস রান্না হইতেছে। ইহাতে আপনার
অর্ধেক ভোজন হয়ে গিয়েছে। সুতরাং আপনি জাতিচ্যূত হইয়াছেন।’
অতঃপর জয়দেব ও কামদেব উক্ত মাংস খাইয়া
মুসলমান হইয়া গেলেন। পীরআলী তাঁহাদিগকে জামাল উদ্দীন, কামাল উদ্দীন খাঁ
চৌধুরী উপাধি দিয়া আমত্য শ্রেণীভুক্ত করিয়া লইলেন। সংশ্রব দোষে অন্য দু্ই
ভ্রাতা শুকদেব ও রতিদেব পীরালি ব্রাহ্মণ নামে সমাজে পরিচিত হইলেন। ইহাই
পীরালি সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিকথা।’ (সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৩/৩৩৪
পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
এ প্রসঙ্গে জনৈক নীলকান্তের বরাত দিয়ে ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থে ঘটকদিগের পুঁথি থেকে কিছু উল্লেখ করেছেন, তা হল-
খানজাহান মহামান পাতশা নফর।
যশোর সনন্দে লয়ে করিল সফর।।
তার মুখ্য মহাপাত্র মামুদ তাহির।
মারিতে বামুন বেটা হইল হাজির।।
পূর্বেতে আছিল সেও কুলীনের নাতি।
মুসলমানী রূপে মজে হারাইল জাতি।।
পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস।
যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হইল সর্বনাশ।।
সুবিধা পাইয়া তাহির হইল উজীর।
চেঙ্গুটিয়া পরগণায় হইল হাজির।।
এখানে লেখক খান জাহানকে কোন মুসলমান
সুলতানের সনদ প্রাপ্ত প্রশাসক বলে উল্লেখ করেছেন। এরপর মুহাম্মদ তাহিরের
পরিচয় তুলে ধরে বলতে চেয়েছেন ইসলামের আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে নয় বরং কোন নারীর
রূপে মুগ্ধ হয়ে সে মুসলমান হয়েছে। প্রকারান্তরে লেখক(সম্ভবত) বলতে চেয়েছেন
ইসলাম প্রচার এদেশে কৌশলে হয়েছে। পুঁথির অন্যত্র এ ব্যাপারে বলা হয়েছে-
আঙ্গিনায় বসে আছে উজির তাহির।
কত প্রজা লয়ে ভেট করিছে হাজির।।
রোজার সে দিন পীর উপবাস ছিল।
হেনকালে একজন নেবু এনে দিল।।
গন্ধামোদে চারিদিক ভরপুর হইল।
বাহবা বাহবা বলে নাকেতে ধরিল।।
কামদেব জয়দেব পাত্র দুইজন।
বসে ছিল সেইখানে বুদ্ধি বিচক্ষণ।।
কি করেন কি করেন বলিলা তাহিরে।
ঘ্রাণেতে অর্ধেক ভোজন শাস্ত্রের বিচারে।।
কথায় বিদ্রূপ ভাবি তাহির অস্থির।
গোঁড়ামি ভাঙ্গিতে দোহের মনে কৈলা স্থির।।
দিন পরে মজলিস করিল তাহির।
জয়দেব কামদেব হইল হাজির।।
দরবারের চারিদিকে ভোজের আয়োজন।
শত শত বকরী আর গো-মাংস রন্ধন।।
পলান্ডু রশুন গন্ধে সভা ভরপুর।
সেই সভায় ছিল আরও ব্রাহ্মণ প্রচুর।।
নাকে বস্ত্র দিয়া সবে প্রমাদ গণিল।
ফাঁকি দিয়া ছলে বলে কত পালাইল।।
কামদেব জয়দেব করি সম্বোধন।
হাসিয়া কহিল ধূর্ত তাহির তখন।।
জারি জুরি চৌধুরী আর নাহি খাটে।
ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন শাস্ত্রে আছে বটে।।
নাকে হাত দিলে আর ফাঁকি তো চলে না।
এখন ছেড়ে ঢং আমার সাথে কর খানাপিনা।।
উপায় না ভাবিয়া দোহে প্রমাদ গণিল।
হিতে বিপরীত দেখি শরমে মরিল।।
পাকড়াও পাকড়াও হাঁক দিল পীর।
থতমত খেয়ে দোহ হইল অস্থির।।
দুইজনে ধরি পীর খাওয়াইল গোস্ত।
পীরালি হইল তাঁরা হইল জাতি ভ্রষ্ট।।
কামাল জামাল নাম হইল দোহার।
ব্রাহ্মণ সমাজে পড়ে গেল হাহাকার।।
তখন ডাকিয়া দোহে আলী খানজাহান।
সিঙ্গির জায়গীর দিল করিতে বাখান।।
‘নবদীক্ষিত জামালউদ্দীন ও কামাল উদ্দীন
প্রচুর সম্পত্তির জায়গীর পাইয়া সিঙ্গিয়া অঞ্চলে বাস করিতে থাকেন। তাঁহাদের
ইসলাম গ্রহণ খুব সম্ভব খান জাহানের পয়গাম তৈরির পরেই হয়েছে। কথিত আছে খান
জাহান তাঁহাদিগকে উচ্চ সম্মানে সম্মানিত করিয়াছিলেন। তিনি বাগেরহাট
অবস্থানকালে এই দুই ভ্রাতা মধ্যে মধ্যে তাঁহার সহিত সাক্ষাত করিতে তথায়
আসিতেন। বাগের হাটের পশ্চিমে সোনাতলা গ্রামে আজিও কামাল খাঁ নামীয় দীঘি
তাঁহার স্মৃতি রক্ষা করিতেছে।’ (সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৬ পৃ.,
এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
ছল ছাতুরী বা কলা কৌশল নয় ইসলামের সুমহান
আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের হাতে হাজার হাজার
অমুসলিম ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন। এই নবদীক্ষিত মুসলমানরা পীরেলি নামে
পরিচিত হন। আর যে হিন্দু মুসলমান হতেন, তার হিন্দু আত্মীয়রা ঐ বংশের
লোকদেরকে সমাজচ্যূত করত। তারা পীরেলি ব্রাহ্মণ বা পীরেলি কায়স্থ নামে
পরিচিত হন। এই পীরেলিদেরকে কুলীণ ব্রাহ্মণরা ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলতেন-
মোসলমানের গোস্ত ভাতে
জাত গেল তোর পথে পথে
ওরেও পীরেলী বামন।
জানা যায়, ‘পীরেলি সম্প্রদায় হিন্দু ও
মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বহন করতো। তাই দেখতে পাই, কলকাতার জোড়া
সাঁকোর ঠাকুর পরিবার, সিঙ্গিয়ার মুস্তফী পরিবার, দক্ষিণ ডিহির রায় চৌধুরী
পরিবার, খুলনার পিঠাভোগের ঠাকুর পরিবার, এই পীরালিদের উত্তরাধিকার হিসাবে
চিহ্নিত। কবি রবীন্দ্রনাথও এই পীরালি ঠাকুর পরিবারেই সন্তান।
সংশ্রব দোষে রায় চৌধুরী পরিবারের লোকেরা
পুত্র কন্যার বিবাহ লইয়া বিড়ম্বিত হইয়া পড়ে। তখন তাহারা প্রতিপত্তি ও অর্থ
বলে সমাজকে বাধ্য করিবার জন্য চেষ্টা চালাইতে লাগিল। ইহাদের সহিত কলিকাতার
ঠাকুর বংশ এবং আরও কতিপয় বংশ সংশ্রব দোষে পতিত হইয়াছিল। কলিকাতার ঠাকুরগণ
ভট্টনারায়ণের সন্তান এবং কুশারী গাঁঞিভুক্ত ব্রাহ্মণ। খুলনা জেলার
আলাইপুরের পূর্বদিকে পিঠাভোগে কুশারীদের পূর্ব নিবাস ছিল। পীঠাভোগের
কুশারীগণ রায় চৌধুরীদের সহিত আত্মীয়তা করিয়া পীরালি হন।’ (সুন্দরবনের
ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৭ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)। ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’,
ব্রাহ্মণ কান্ড, তৃতীয় ভাগ, ষষ্ঠ অংশের ১৭২ পৃষ্ঠায় এ প্রসঙ্গে বর্ণিত
হয়েছে, ‘বর্তমান কালে খুলনা জেলার অন্তর্গত পিঠাভোগ গ্রামের কুশারী
মহাশয়েরা চেঙ্গুটিয়ার গুড় চৌধুরীগণের ন্যায় শক্তিশালী প্রবল শ্রোত্রিয়
জমিদার ছিলেন। ইহারা শান্ডিল্য ভট্টনারায়ণ পুত্র দীন কুশারীর বংশধর। যে সময়
শুকদেব রায় চৌধুরী বিশেষ বিখ্যাত জমিদার হইয়াছিলেন।ইনি পিঠাভোগের কুশারী
বংশীয় সুপ্রসিদ্ধ শ্রীমন্ত খানের কোন আত্মীয় হওয়াই সম্ভব।’(বঙ্গের জাতীয়
ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কান্ড, তৃতীয় ভাগ ষষ্ঠ অংশের ১৭২ পৃ., নরেন্দ্রনাথ বসু)।
“কুশারী বংশের পঞ্চানন থেকেই পরবর্তীকালে
কলকাতার বিখ্যাত জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বংশের প্রতিষ্ঠা হয়।”(খুলনা জেলায়
ইসলাম, মুহম্মদ আবু তালিব, পৃ. ৭১)।
অন্যদিকে মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁকে
অনেকেই পীরালী বংশোদ্ভুত মনে করেন। এ প্রসঙ্গে এ.এফ.এম. আবদুল জলীল বলেন,
“মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ এই পীরালী বংশের কৃতি সন্তান। তাঁহার আত্মীয়
স্বজন পীরালি খাঁ বলিয়া পরিচিত। আমি মাওলানা সাহেবের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে
আলোচনা করিয়াছি। তাঁহার বংশ পীরালি তাহা তিনি স্বীকার করেন না। তিনি বলেন
যে, গৌড়ের সুলতান যদু বা জালাল উদ্দীনের সময় হইতে তাঁহারা মুসলমান এবং জনৈক
আলী খানের বংশধর। (সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৭ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল
জলীল)।
এ বিষয়ে হান্টার সাহেব বলেছেন, “সমস্ত রায়
চৌধুরীগণ খান চৌধুরীতে পরিণত হয়। কিন্তু মাওলানা সাহেবের বংশ খান চৌধুরী
নহে, শুধু খাঁ উপাধিধারী।”(সুন্দরবনের ইতিহাস, ৩৩৭ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল
জলীল)।
অন্যত্র এ.এফ.এম. আবদুল জলিল সাহেব
লিখেছেন, ‘কলিকাতা এবং স্থানীয় সম্ভাব্য সমস্ত সূত্র হইতে জানিয়া আমাদের
মন্তব্য সন্নিবেশিত করিলাম। রায় চৌধুরী বংশের পূর্ব পুরুষদের সহিত রবি
বাবুর যেরূপ রক্তের সম্পর্ক, মাওলানা আকরাম খাঁ সাহেবের সম্পর্ক ঠিক
ততটুকু।’ (সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৮ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
“হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির পয়গ্রাম
অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন বলে জানা যায়। জানা যায়, পরে তিনি খলিফাতাবাদ
রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।”(হযরত খানজাহান আলী(র), পৃ. ৬-সেলিম
আহমদ)।
প্রখ্যাত গবেষক জনাব অধ্যাপক আবূ তালিব
বৈষ্ঞব ধর্মের প্রবক্তা শ্রীচৈতন্যের প্রচারিত আদর্শ সম্পর্কে বলতে গিয়ে
বলেছেন, “সত্যি বলতে কি, পীরালি আবু তাহিরই ছিলেন শ্রীচৈতন্যের পূর্বসূরী।
আবূ তাহিরের আবির্ভাব যাদেরকে পবিত্র ইসলাম ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করেছিল,
শ্রী চৈতন্য তাদেরকে বৈষ্ঞব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন।(খুলনা
জেলায় ইসলাম, ৬৯ পৃ.-মুহাম্মদ আবূ তালিব)।
এরপরই তালিব সাহেব বলেছেন, “ধর্ম প্রচারের
ব্যাপারে পীরালী সাহেব শ্রীচৈতন্যের দিশারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
শ্রীচৈতন্য তাঁরই পথের অনুসারী ছিলেন। আরও বলা যেতে পারে, নির্যাতিত হিন্দু
পীরালী সমাজ একাধারে চৈতন্যের ধর্ম ও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে শান্তি
প্রাপ্ত হয়েছিলেন।(খুলনা জেলায় ইসলাম, ৬৯ পৃ.-মুহাম্মদ আবূ তালিব)।
যা হোক পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের প্রধান
কর্মকেন্দ্র হয় পয়গ্রাম কসবায়। “হযরত খানজাহান এই গ্রামটিকে তাঁর বিশাল
সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত রাজধানী শহর করার সুসংবাদ প্রদান করেন। এবং অবিলম্বে
গ্রামটিকে একটি ‘কসবা’ বা শহরে পরিণত করেন। (খুলনা জেলায় ইসলাম, ৬৮
পৃ.-মুহাম্মদ আবূ তালিব)।
পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের জন্মস্থান হচ্ছে
যশোহর জেলার নড়াইল মহকুমার(বর্তমানে জেলা) পেড়োলি গ্রামে। হযরত পীর আলী’র
নামেই গ্রামটির নামকরণ হয় ‘পীরালী’। বর্তমানে নামটির বিকৃত রূপ হচ্ছে
‘পেড়োলি’।
হযরত পীর আলী’র নিকট এত অধিক সংখ্যক
ব্রাহ্মণ মুসলমান হন যে, নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ আর ছিলনা বললেই চলে। এজন্য
অন্যান্য হিন্দু ব্রাহ্মণগণ ভয় পেয়ে যান ও চিন্তিত হয়ে পড়ে। মধ্যযুগের
বাংলা সাহিত্যে এর স্বাক্ষ্য মেলে-
পীরাল্যা গ্রামেতে বৈসে যবেত যবন।
উচ্ছন্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ জবনে বাদ যুগে যুগে আছে।
বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।
কবি আরো বলেন-
পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস।
যে গায়েতে নবদ্বীপের হৈল সর্ববনাস।।
অথবা
“বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের আড়ে।
৮৬৩ হিজরী মোতাবেক ১৪৫৯ সালে এ মহান
কামেলে দ্বীন ও ইসলাম প্রচারক ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাজার বাগেরহাট হযরত
উলূঘ খান জাহান আলীর(র) মাজারের পাশেই আছে। এ সম্বন্ধে সতীশ চন্দ্র মিত্র
লিখেছেন, “মুহাম্মদ তাহির এখানে মারা যান নাই, এখানে মাত্র তাঁহার একটি
শূন্যগর্ভ সমাধিবেদী গাঁথা রহিয়াছে।…..বন্ধুর স্মৃতি চিহ্ন রাখা কর্তব্য এই
বুদ্ধিতে খাঁ জাহান মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে সেই একই জেলহ্জ্জ মাসে
মুহাম্মদ তাহিরের জন্য এই স্মৃতি স্তম্ভ গঠিত করিয়া রাখিয়া যান। সমাধির
উপরিভাগটি প্রায় খান জাহানে সমাধির ন্যায়, তবে ইহার ভিতরে কিছুই নাই, সিঁড়ি
দিয়া তন্মধ্যে অবতরণ করা যায়।” (যশোহর খুলনার ইতিহাস, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৮,
সতীশ চন্দ্র মিত্র)। সতীশ বাবুর এই মন্তব্যের সহিত আমরা কোনভাবেই একমত হতে
পারিনা। কবরের নীচে এ ধরনের সুড়ঙ্গের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রযেছে। তা’ছাড়া
আমরা পূর্বেই তাঁর মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করেছি।
তাঁর শিলালিপিতে লেখা আছে, “হাজিহি
রওজাতুন মুবারাকাতুন মির রিয়াজিল জান্নাতি ওয়া হাজিহি সাখরিয়া তুল
লিহাবীবিহি এসমুহু মুহাম্মদ তাহির ছালাছা সিত্তিনা ওয়া সামানিয়াতা।” অর্থাৎ
এই স্থান বেহেশতের বাগিচা সদৃশ এবং ইহা জনৈক বন্ধুর মাযার, নাম-আবু তাহির,
ওফাতকাল-৮৬৩ হি/১৪৫৯ খৃষ্টাব্দ। এই একই বৎসর হযরত খান জাহান (রঃ) এর ওফাত
হয়।
No comments:
Post a Comment